সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের আদ্যোপান্ত

|

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ঘটে গেছে দেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা। শনিবার রাত আনুমানিক ১০টা দিকে আগুনের সূত্রপাত। কনটেইনার ডিপোতে থাকা রাসায়নিকের ভয়াবহ বিস্ফোরণে আশপাশের অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। তাৎক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু ডিপোতে থাকা মালামাল সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় সেখানকার ফায়ার ফাইটাররাই সবচেয়ে বেশি হতাহতের শিকার হয়েছেন। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি আগুন।

৪৪ জনের মৃত্যু
আগুনে দগ্ধ হয়ে নয়জন উদ্ধারকারী ফায়ার সার্ভিসকর্মীসহ ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া কয়েকশ মানুষ আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, সিএমএইচসহ আশপাশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছে। গুরুতর আহত অবস্থায় আইসিইউতেও রাখা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। ঢাকায় বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়েছে গুরুতর আগত ১৪ জনকে।

হাসপাতালে মানুষের ভিড়
প্রতি মুহূর্তে আহতদের নেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিএমএইচে। হাসপাতালগুলোতে, বিশেষ করে চমেকে উৎসুক মানুষ, রোগীদের আত্মীয় ও সাহায্য করতে আসা সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড়। হাতে হাতে সাহায্য ছাড়াও অনেকে রক্তদান, রক্ত ও ওষুধ সংগ্রহ করে যার যার সামর্থ অনুযায়ী দগ্ধদের সাহায্য করছেন। অনেকেই নিখোঁজ আত্মীয়দের খুঁজতে হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হাসপাতালে দগ্ধদের আর্তনাদ ও আত্মীয়দের আহাজারিতে এক আর্দ্র অবস্থা তৈরি হয়েছে। সেখানে মানুষের ভিড়ের জন্য চিকিৎসাসেবা ব্যহত হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।

বিস্ফোরণ এখনও অব্যাহত
গতকাল রাত থেকে বিস্ফোরণ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত থেমে থেমে বিস্ফোরণ অব্যাহত রয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর বিকট শব্দে বিস্ফোরণ চলতে থাকায় উদ্ধারকর্মীদের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, কনটেইনারগুলো এখনও বিস্ফোরিত হওয়ায় সেখানকার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। এমনকি আজ দুপুর পর্যন্ত কনটেইনার বিস্ফোরিত হওয়ায় মূল জায়গাটিতে উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছাতেই পারেনি।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন বাহিনীর সম্মিলিত তৎপরতা
ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৫০ জন সদস্য উদ্ধার অভিযানে যোগ দিয়েছেন। আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সহায়তায় কাজ করছে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দলও। রয়েছে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার এবং নিরাপত্তা দল; তাদের সাথে আছে মিলিটারি পুলিশ। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক সামগ্রী সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া রোধে কাজ করছেন। আর বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতে কাজ করে চলেছে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম।

ডিপোতে ছিল বিপুল রাসায়নিক
বিএম কনটেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোর কর্মীরা সংবাদমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রচণ্ড দাহ্য এই রাসায়নিক উত্তপ্ত হলে বিস্ফোরকের আচরণ করে। ডিপোতে আমদানি ও রফতানির বিভিন্ন মালামালবাহী অন্তত ৫০ হাজার কনটেইনার ছিল বলেও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় বাসাবাড়ির ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আশপাশের বাসাগুলোর জানালার কাচ ভেঙে পড়াসহ বিকল হয়ে গেছে ফ্রিজ, টেলিভিশন, ফ্যানসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। ডিপোর আশপাশের টিনের ছাউনির ঘরগুলোর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা কালো ও বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে ঘরে টিকতে পারছেন না। অনেকে বিষাক্ত ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও জানা গেছে।

ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি মালিকপক্ষকে
আজ দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত ডিপোর মালিক বা কোনো কর্মকর্তাকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, মালিকপক্ষের কাউকে না পাওয়ায় তারা বুঝতে পারছিলেন না কোন স্থানে কী ধরনের বিস্ফোরক রাসায়নিক রয়েছে। এর ফলে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়েছে। এজন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি সময় লাগছে বলেও জানান তিনি।

ঢাকায় আনা হচ্ছে রোগীদের
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কয়েকজনকে ভর্তি করা হয়েছে। আরও রোগীদের হেলিকপ্টারে করে আনার জন্য জরুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানে সরকারের পাশাপাশি দলীয় নেতা কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply