আন্তর্জাতিক বাজার এবং সময় বিবেচনায় জ্বালানির তেলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ববাজারে তেলের দাম আরও কমবে আশা করে ড. ম তামিম বলেছেন, এমন অবস্থায় খুব বেশি ভর্তুকি দিতে হতো না সরকারকে। যদিও বিশ্ববাজারে কমলে দেশে মূল্য কমানোর আশ্বাস দিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীও স্বীকার করছেন, নতুন দর সহনীয় হবে না সবার কাছে। তার দাবি, অর্থনীতি বাঁচাতে বাধ্য হয়েই দাম বাড়িয়েছে সরকার।
জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছে সাধারণ মানুষ। এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর নতুন রেকর্ড দেখলো তারা। সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ, হতাশ খেটে খাওয়া আর নির্ধারিত আয়ের মানুষ। সকলের চিন্তা একটাই, কোথা থেকে আসবে যাপিত জীবনের বাড়তি খরচ! তারা বললেন, এখন হু হু করে দাম বাড়বে সবকিছুর। মানুষের এসব ভয়-ভোগান্তি আর উদ্বেগের কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই নীতি নির্ধারকদেরও। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এই দাম বৃদ্ধি সব মানুষের কাছে সহনীয় নয়। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশেও জ্বালানির মূল্য কমানো হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
একবারে জ্বালানি তেলের দাম এতোটা বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এটি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। অনেকটা হুট করেই বাড়ানো হলো জ্বালানির তেলের দাম। বেড়েছে ৪২ থেকে ৫০ শতাংশের ওপরে। একলাফে এতো দাম বৃদ্ধি করায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সবকিছুরই দাম বড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ। তাদের প্রশ্ন, তারা কোথায় যাবে! একজন যেমন বললেন, প্রতি লিটারে ৪৮ টাকা দাম বাড়লে কি মানা যায়! আমরা যারা মধ্যবিত্ত, তাদের প্রতি এই ধরনের সিদ্ধান্ত অমানবিক বিচার ছাড়া কিছুই না!
পেট্রোলে আমদানি করে না সরকার। তারপরও কেন সেটির দামও বাড়লো, সেই প্রশ্নও উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাসে বলছেন, সামনে আরও কমবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম। সরকারের এ খাতে ভর্তুকি কমবে আরও। এ অবস্থায় বাড়তি দামের যে বহুমুখী প্রভাব, বিশেষ করে পরিবহন খাতে, তা সামলানো কঠিন হতে পারে বলে রয়েছে আশঙ্কা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ভর্তুকি তো ৮ হাজার কোটি টাকা সরকার দিয়েই দিয়েছে। এখন কিন্তু সামনে ভর্তুকি দেয়ার পরিমাণ খুব কম লাগতো তাদের। দিলেও সহনীয় পর্যায়ে খুব কম দিতে হতো; প্রতি লিটারে হয়তো সর্বোচ্চ ৮-১০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে, যা আগে ১৫-২০ টাকাও দিতে হতো। এই সময় তাই এত বেশি মূল্য বাড়ানোর যৌক্তিকতা আমি দেখি না। শুধু জ্বালানির অংশটুকু যদি আমরা দেখি, মাত্র ১৬ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি হবে। এখন আমরা দেখি, ১৬ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির মধ্যে আমরা থাকতে পারি কিনা।
এমন অবস্থায় ঘোষিত দাম পুনর্বিবেচনার পরামর্শ অধ্যাপক তামিমের। তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করে সরকারের একটা মধ্যপন্থায় আসা উচিত। কিছুটা দাম হয়তো বাড়াতে হবেই।
আগে থেকে চাপে রয়েছে রফতানি খাত। জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে সেটা আরও বাড়বে; যা সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, এ পরিস্থিতিতে নতুন নতুন সংকট সামনে আসবে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও। বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আসলে আমরা শঙ্কিত যে সামনে কী হবে! কোথায় যাচ্ছি আমরা! এই মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক। এরপর যে বিদ্যুতের মূল্য বাড়বে, তার চাপ কি আমাদের ওপর আসবে না? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যখন ঘটবে, পরিবহন ব্যয় যখন বাড়বে তখন তার প্রভাব সবক্ষেত্রেই পড়বে। এসব আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভর্তুকির চাপ পুরোটাই সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যা অযৌক্তিক। পুরো উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; আর সেই প্রভাব উস্কে দেবে মূল্যস্ফীতি। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হয়। এবং এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতিজনিত যে প্রতিক্রিয়া রয়েছে দেশের ভেতরে, সেই মূল্যস্ফীতিকে আরও কিছুটা উস্কে দেবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন: বিশ্ব বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে: নসরুল হামিদ
সাধারণ মানুষের চাপের কথা স্বীকার করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রীও। তবে সরকারের হাতে দাম সমন্বয়ের বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের দাবি, বাধ্য হয়েই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলে দীর্ঘদিন যাবত বিশাল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে আসছিল সরকার। বাস্তবে যে মূল্যে আমরা কিনি তার এক-চতুর্থাংশ মূল্যেও বাজারে বিক্রি করি না। জ্বালানি হচ্ছে কেন্দ্রীয় দ্রব্য, সকল দ্রব্যের সৃষ্টিতে যার ভূমিকা প্রধান। সেই জ্বালানির মূল্য যখন বেড়েছে, আর কেবল বাড়া নয় বেশ বড় অঙ্কের বেড়েছে তখন আঘাতটাও বড় আসবে। সেটা অস্বীকার করার কোনো মানে হবে না। আইএমএফ বলুন কিংবা বিশ্বব্যাংক, তাদের সংস্কারের মানে হচ্ছে তারা যে নিয়মকানুনের কথা বলেছে সেগুলো মেনে চলতে হবে।
আরও পড়ুন: তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নির্দয় ও নজিরবিহীন: জি এম কাদের
/এম ই
Leave a reply