কথায় আছে— রোম একদিনে গড়ে ওঠেনি। যেকোনো সাফল্যের পেছনে লেগে থাকতে হয়, ভেঙে পড়লে অসাধ্যসাধন করা যায় না। একবার ভেবে দেখুন, ২০ বছর আগেও বাংলাদেশের ক্রিকেট কোথায় ছিল? এখনকার, সাকিব-মুশফিকরা রাতারাতি গড়ে ওঠেননি। এর পেছনে অনেক সাধনার গল্প আছে, অনেকের হাতের ছোঁয়া আছে। তেমনই একজন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ফাহিম স্যার। বিকেএসপি’র শুরু থেকেই ক্রিকেটের প্রধান কোচ ছিলেন। এরপর বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজারের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। কিছুদিন আগে দেয়া হয়েছিল নারী ক্রিকেট দলকে দেখভালের দায়িত্ব। কী দারুণভাবে না বদলে দিলেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ইতিহাস! তার তত্ত্বাবধানে এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে সোনার হরিণ শিকার করেছেন বাংলাদেশের নারীরা। আর কী কাকতাল- সেদিন ছিল তার জন্মদিন! মাঠের খেলা ক্রীড়াপ্রেমীরা উপভোগ করেছেন, যারা দেখতে পারেননি সামাজিক মাধ্যমে হয়তো দেখে নিচ্ছেন সাফল্যের নিদর্শন। তবে, অনেকটাই আড়ালে থেকে যায় মাঠের পেছনের খেলাটা। নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সাথে কথা বলে এমন সাফল্যের পেছনের গল্প তুলে এনেছেন যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তাহমিদ অমিত।
এশিয়া কাপ ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক আসরের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। তাদের ৯ উইকেটে গড়া ১১২ রান ৭ উইকেট খরচ করে শেষ বলে পার হয়েছে টিম টাইগ্রেস। অজেয় ভারতের দম্ভচূর্ণ করে আক্ষেপে আটকে থাকা ভাগ্যের শিকে ছিড়েছেন বাংলার মেয়েরা। কোচ না হয়েও যে দলের শিরোপা জয়ের পেছনের নায়ক একজন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। কীভাবে এলো এমন সাফল্য?
ফাহিম জানান, ‘আমি যখন নারী ক্রিকেট দলের দেখভালের দায়িত্বে আসি প্রথমেই মনে হয়েছে অনেক মেয়ে ভালো খেলে। তবে তাদের খেলার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাবটা ছিল প্রচণ্ড রকমের। ওরা নিজেরাই জানে না যে কতো ভালো খেলতে পারে ওরা। আমার মনে হয়েছিল যে ওদের মধ্যে এ বিশ্বাসটা ঢুকানো উচিত যে ওরা ভালো খেলতে পারে। এটাতে অনেক সময় দিয়েছি।’
একদিনে উন্নতি আসেনি, ঘরোয়া ক্রিকেটেও দিয়েছিলেন বিশেষ মনোযোগ। জানালেন, ‘গত এক বছরে ডোমেস্টিক ক্রিকেটে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। সেখানে যেন শুধু খেলার জন্য খেলা না হয় এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছি। যদিও সবদিক থেকে খুব সাপোর্ট পেয়েছি তাও না। কারণ মেয়েদের ক্রিকেট খেলা খেয়াল করার সময় অনেকেরই হয় না। তবে আমরা চেষ্টা করেছি মাঠে যেন যথাযথ নিয়ম মেনে খেলা হয়, খেলায় যেন প্রতিযোগিতা থাকে। যেনতেনভাবে খেলা শেষ হয়ে না যায়।’
এরপর, আন্তর্জাতিক সফরে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান রোমানারা। সেখানে রীতিমতো নাকাল হয়ে আসতে হয়েছে তাদের। অথচ, আত্মবিশ্বাসী ফাহিম সেখান থেকেই খুঁজে নিয়েছেন সাফল্যের রসদ। জানান, ‘অনেকে আমাকে বলেছিল যে সাউথ আফ্রিকা সফর একদম যাচ্ছেতাই হয়েছে। আমরা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। আমি তাদের সবাইকে বলেছি, যে এখান থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। সে শিক্ষা নিয়ে দল গোছানোর সুযোগ পেয়েছি। আমাদের দলটা এখন অনেক গোছানো। এখানে সবাই এখন জানে যে কার কী কাজ, কী করতে হবে এবং কীভাবে সেটা করতে হবে। এটা আস্তে আস্তে সবাই বুঝতে শুরু করেছে। সবদিক থেকে এই দলটা আস্তে আস্তে পরিণত হয়েছে।’
দায়িত্ব নিয়েই কোচিং স্টাফে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিলেন ফাহিম। জানিয়েছেন সে কথাও, ‘আমাদের কোচ তো ছিলই। ভারত থেকে দু’জন সহকারী কোচ আনা হয়েছে। নতুন ফিজিও এনেছি। কিছু পার্থক্য তো এসেছেই। অনেক বিদেশি কোচের মধ্যে যেটা আমরা দেখেছি যে আমাদের নিয়ে তাদের ভাবনা চিন্তাগুলো খুব নিচু মানের হয়। তারা ভাবে যে আমরা ভালো করতে পারবো না। একটু ভালো কিছু হলেই তারা খুশি হয়ে যায়। অথচ আমাদের এখানে অনেক মেধাবী ক্রিকেটার আছে- সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক। ভালো গাইড পেলে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ভালো করতে পারবে। সেটা তারা মাঝে মাঝেই দেখিয়েছে।’
মেয়েদের ক্রিকেটের অবকাঠামো অনেক দুর্বল। প্রয়োজন বড় ধরনের বিনিয়োগ। ফাহিম মনে করেন ভালো খেলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার একটা প্রভাব থাকবে। এখন, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আরও সহজ হবে। সবাই হয়তো ভাববে এখানে ইনভেস্ট করলে ভালো হবে। এটা খুবই জরুরি। এখানে ইনভেস্টমেন্ট আসলেই অনেক কম।’
খেলোয়াড় গড়ে তোলার কারিগর, তাই ঘুরে ফিরে বারবারই বললেন ঘরোয়া ক্রিকেটেরই কথা, ‘এভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আমাদের ডোমেস্টিক ক্রিকেটে দারুণভাবে প্রভাব ফেলবে। যারা ডোমেস্টিক ক্রিকেট খেলে তারা এখন নিজেদের অন্য মাত্রায় ভাবতে শুরু করবে। আগে যেভাবে খেলতো সেখান থেকে তারা দারুণভাবে বেরিয়ে আসবে।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের একজন অভিভাবক তিনি। নারী ক্রিকেটারদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গেও কথা বললেন, ‘এটা আসলে নির্ভর করে আমরা মেয়েদের ক্রিকেটকে কোথায় দেখতে চাই তার ওপর। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করতে হলে তাদের আর্থিক সুরক্ষা দিতে হবে যেন তারা এদিকে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারে। এখন যেহেতু ওরা ভালো খেলে নিজেদের প্রমাণ করেছে আমি আশাবাদী যে এই দিকটা নিশ্চিত করা হবে। ওরা সুরক্ষা পেলে আরও ভালো খেলতে পারবে।’
নাজমুল আবেদীন ফাহিমের ক্রিকেট দর্শন প্রভাব ফেলেছে মাঠের খেলায়। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন বাংলাদেশের নারীরা। এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি, ‘তাদের কোচিং স্টাফরা আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমাদের মেয়েদের ওরা অনেক সমীহ করে খেলেছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে ম্যাচের শুরু থেকেই আমরা ওদের চাপে রেখেছিলাম। খেলার মাঠে এভাবে সমীহ আদায় করে নেয়াটা বড় ব্যাপার।’
বাংলার নারী ক্রিকেটাররা এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী। পাশাপাশি, সারা দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরাও মনে করেন উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আরও বড় অর্জন ছিনিয়ে আনবেন ‘ফাহিম স্যারের শিষ্যরা’।
যমুনা অনলাইন: টিএ/টিএফ
Leave a reply