নীল বেদনা ঘিরে ধরার চার বছর আজ

|

আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

রূপালি গিটার থেমে নীল বেদনা ঘিরে ধরার দিন আজ। বোবা অশ্রুতে নোনা হয়ে যাওয়া চেতনার বয়স চার বছর হলো। আজ ১৮ অক্টোবর। উপমহাদেশের কিংবদন্তি গিটারিস্ট, সুরের জাদুকর, গীতিকার ও সংগীতশিল্পী, জনপ্রিয় ব্যান্ড এলআরবির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

গানে গানে সারা বাংলাদেশ ও বিশ্বের বাংলাভাষীদের জাগিয়ে দেয়া এক ব্যান্ড এলআরবি। রুচিশীল রক, হার্ডরক, ব্যালাড রক গান দিয়ে আমজনতার খুব কাছে পৌঁছে যান আইয়ুব বাচ্চু ও এলআরবি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের গান আন্দোলিত করে চলেছে সংগীতপ্রেমীদের। এই এলআরবির প্রাণ ছিলেন শ্রোতাদের ভালোবাসার ‘এবি’।

ছবি: সংগৃহীত

গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু তার সংগীতজীবনের শুরুর দিকে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে ‘স্পাইডার’ নামে আরেকটি ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হন। কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গে কয়েক বন্ধু মিলে ‘রিদম সেভেন্টি সেভেন’ নামে আরও একটি ব্যান্ডে কিছুদিন গিটার বাজান বাচ্চু। ১৯৭৯ সালে কুমার বিশ্বজিতের সঙ্গে যোগ দেন ব্যান্ড ফিলিংসে। সেখান থেকে বেরিয়ে ১৯৮০ সালে গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রামের আলোচিত ব্যান্ড ‘সোলস’এ। সোলসের সঙ্গে দীর্ঘ ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য অনেক গান তার কম্পোজিশন করা। তার কণ্ঠে আছে সোলসের একাধিক গানও। এর মধ্যেই আইয়ুব বাচ্চুর দুটি সোলো অ্যালবামও প্রকাশ হয়, ১৯৮৬-তে ‘রক্তগোলাপ’ এবং ১৯৮৮-তে ‘ময়না’, দ্বিতীয় অ্যালবামটি অধিক সমাদৃত হয়।

১৯৯১ সালের এপ্রিলে আইয়ুব বাচ্চু একটি নতুন ব্যান্ড দল গঠন করেন। ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ইয়েলো রিভার ব্যান্ড’। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল ইয়েলো রিভার ব্যান্ড আমেরিকান ক্লাবে শো করবে। শো’র আগে ব্যান্ডের নাম ইয়েলো রিভার ব্যান্ডের পরিবর্তে ভুলবশত লিটল রিভার ব্যান্ড নামে পোস্টারিং করা হয়। শো করার সময় আইয়ুব বাচ্চু জানতে পারেন, তাদেরকে সবাই চিনে গেছে লিটল রিভার ব্যান্ড নামে। সে থেকে এটাই ব্যান্ডের নাম হয়ে যায়।

এলআরবির প্রথম দিকের লাইনআপ। ছবি: সংগৃহীত

শুরু থেকেই এলআরবির নিজস্ব কম্পোজিশনের একটা ভান্ডার তৈরি হতে থাকে। গান বেশি হয়ে যাওয়ায় তারা ডাবল অ্যালবাম রিলিজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯২ সালে সারগামের ব্যানারে এলআরবি দেশের প্রথম ডাবল ক্যাসেট অ্যালবাম রিলিজ করে। অ্যালবামটি বাংলাদেশের রক ও হার্ডরক হিসেবে তো বটেই, এটি বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে আছে। অ্যালবামের ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘ফেরারি এ মন’, ‘মাধবী’, ‘শেষ চিঠি’, ‘হকার’, ‘পেনশন’ গানগুলো এলআরবি-১ অ্যালবামকে এনে দেয় তৎক্ষণাৎ শ্রোতাপ্রিয়তা। বিশেষ করে, আইয়ুব বাচ্চুর গিটার ও গানে একটা চমক খুঁজে পান শ্রোতারা। ১৯৯৩ সালে সাউন্ডটেকের ব্যানারে প্রকাশ হয় এলআরবির দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘সুখ’। আইয়ুব বাচ্চুর গিটার ও কণ্ঠের মূর্ছনায় ভরা ‘গতকাল রাতে’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘সুখ’ গানগুলো অমরত্ব পায়। হার্ডরক, রক অ্যান্ড রোল, সফট রক ধাঁচের গানগুলো ঘরে ঘরে বাজতে থাকে। আইয়ুব বাচ্চুর নিজের লেখা ও সুর করা ‘চলো বদলে যাই’ গানটি পরবর্তী সময়ে ‘সেই তুমি’ নামেও পরিচিত হয়। এই গান সৃষ্টির পর আর একই থাকলো না বাংলা রক কনসার্টের ইতিহাস। ‘চলো বদলে যাই’ বলে আইয়ুব বাচ্চু বদলে ফেললেন বাংলার রকম্যানিয়া।

১৯৯৫ সালে প্রকাশ হয় এলআরবির পরবর্তী অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’। অ্যালবামের ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘সুখী ছেলে’, ‘বেইলি রোড’ গানগুলো জনপ্রিয় হয়। পরের বছর ১৯৯৬ সালে, এলআরবি দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করে। স্টুডিও অ্যালবাম “স্বপ্ন” এবং আনপ্লাগড লাইভ অ্যালবাম ‘ফেরারি মন’। স্বপ্ন অ্যালবামের ‘রাতের তারা’, ‘চাঁদ মামা’ গান দুটো জনপ্রিয় হয়। সে বছরই এলআরবি, ফিলিংস ব্যান্ডের সঙ্গে সাউন্ডটেক থেকে প্রকাশ করে ‘ক্যাপসুল ৫০০’ অ্যালবাম। অ্যালবামে দুটি ব্যান্ডের ৫টি করে নতুন ১০টি গান প্রকাশ হয়। অ্যালবামে এলআরবির ‘হাসতে দেখো’, ‘আহা জীবন’, ‘নীল বেদনা’ গানগুলো যেন বাংলা রকের ইতিহাসে জায়গায় করে নেয় অমরত্বের প্রত্যাশায়।

ছবি: সংগৃহীত

আইয়ুব বাচ্চু মূলত এমন এক রকস্টার, যিনি জিমি হেনড্রিক্স, জো স্যাট্রিয়ানি, স্টিভ ভাই, ডেভ গিলমোরদের ঢঙে পরিবেশন করে গেছেন বাংলাদেশের এক চাকরি প্রত্যাশী বেকারের হতাশার কথা; বড় বাবু মাস্টারদের প্রতি নিবেদন কিংবা, দেহপসারিণীর সংগ্রামের জীবনালেখ্য।

যে সময় হার্ড রক গান করাই ছিল দারুণ এক দুঃসাহসিক কাজ আর, শ্রোতারাও ছিল না প্রস্তুত; সে সময় আইয়ুব বাচ্চু হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, নব্বইয়ে কমিউনিজমের পতনের পরে পৃথিবীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটা বদলের হাওয়া লেগেছে। হার্ড রকের পাশাপাশি ব্যালাড ও মেলোডিতে আইয়ুব বাচ্চুর বড় এক সাফল্যের নাম ‘কষ্ট’ অ্যালবাম। ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি/ তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’ পৌঁছে যায় দেশের আনাচে কানাচে, শহর থেকে গ্রামে। রিকশাচালক, ছাত্র, কোটিপতি বা বহুজাতিক কোম্পানির ম্যানেজার- নির্বিশেষে সবাইকে ‘কষ্টে’ ভাসিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু।

এলআরবির শেষ দিকের লাইনআপ। ছবি: সংগৃহীত

এরপর অবশ্য গানের থিমেও পরিবর্তন আনেন তিনি। কষ্ট, বেদনা ও নিঃসঙ্গতাকে ঘিরে আবর্তিত হয় তার গান। বাচ্চু আমাদের শোনান ঘুমন্ত শহরের কাব্য। বললেন এক বিষাদগ্রস্ত মানুষের গল্প- নিয়ন জ্বলা রাতে নগরের সকল বিষাদের ভার নিয়ে বিনিদ্র জেগে থাকার কথা। কষ্টের শীতল আবরণ জড়িয়ে একাকী ভিন্ন গ্রহের থাকার সেই বেদনা হয়তো ভেতরে ভেতরে বহন করে প্রতিটি মানুষ।

তবে শ্রোতাদের পরীক্ষা নেয়া তখনও থামানি এবি। নিয়ে এলেন অবিস্মরণীয় রক ব্যালাড ‘নীল বেদনা’। বাউলের একতারার কান্না ভর করলো রূপালি গিটারে, শোনালো বুকভরা দুঃখের ক্ষতের সুর। আর, শ্রোতাদের বোধে নিয়ে আসলো এক আশ্চর্য চন্দ্রালোক। রূপালি গিটার থেমে গিয়েছিল চার বছর আগের এই দিনে। বাংলা রকের জগতে তৈরি হয় এক অপূরণীয় শূন্যস্থান, সেখানে কেবলই নীল তরঙ্গ। আইয়ুব বাচ্চু যেনো সকলের সেই আত্মীয়, যার প্রস্থানের অর্থ, দূর অতীতের দুঃখ ডাকে আমায়।

/এম ই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply