জয়ের পরও ভোট কেনার টাকা ফেরত পেতে নারী ইউপি সদস্যকে হুমকি!

|

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যরত ভুক্তভোগী মহিলা ইউপি সদস্য মোরশেদা বেগম।

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

নির্বাচিত হওয়ার পরও ভোট কেনার জন্য দেয়া ৫০ হাজার টাকা ফেরত না দেয়ায় এক মহিলা ইউপি সদস্যকে হুমকি দেয়া ও শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে রংপুরের কাউনিয়া থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে।

সোমবার (৩১ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী মহিলা ইউপি সদস্য মোরশেদা বেগম। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত আলতাফ হোসেনের দাবি, অভিযোগকারী সম্পর্কে আমার মামি। জমিজমা ও টাকা-পয়সা সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা ভোটের আগে ঘটেছিল।

এদিকে, টাকার বিনিময়ে ভোট কিনে নির্বাচিত হওয়ায় আলতাফ হোসেনের সদস্য পদ বাতিল করে ওই ওয়ার্ডে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী গোলাম সারোয়ার আনছারী।

সোমবার দুপুরে রংপুরের কাউনিয়ার হারাগাছ ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য মোরশেদার এ সংবাদ সম্মেলন ঘিরে এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলতে মোরশেদা হক বলেন, গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনের ২ নং ওয়ার্ডে (কাউনিয়া) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন আলতাফ হোসেন। নির্বাচনের আগে ১৫ অক্টোবর আলতাফ হোসেন হারাগাছ ইউপির সদস্য মোজাম্মেল হকের মাধ্যমে অপর ইউপি সদস্য জহুরুল হকের বাড়িতে রাত সাড়ে তিনটায় আমাকে জিম্মি করে আমাকেসহ ৭ পুরুষ ও মহিলা সদস্যকে ডেকে আনেন। সেখানে আলতাফ হোসেন তাকে ভোট দেয়ার জন্য আমাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার করে টাকা দেন। আমি তার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ভোট দেই এবং তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।

তিনি বলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর গত ১৯ অক্টোবর আমাকে ফোন দিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন আলতাফ। আমি সে ভাষা প্রকাশ করতে পারবো না। এ সময় তিনি আমাকে বলেন, আমি নাকি তাকে ভোট দেই নাই। সে কারণে টাকাসহ বাকি সরঞ্জামাদি ফেরত দিতে বলেন তিনি। পরে আবারও আলতাফ হোসেনের দলীয় লোক ও বন্ধু মশিয়ার রহমানের মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে ফোন দিয়ে বলেন, টাকা ফেরত দাও। তা না হলে আমার কাপড় খুলে নিবে, বেইজ্জতি করবে- এরকম হুমকি দেয়। আমি মোবাইল কেটে দিলে আলতাফ আবারও ওই মোবাইল থেকে আমার স্বামীর মোবাইলে কল দেয়। আমার স্বামীকেও সে একই হুমকি দেয়। এসব কলের রেকর্ড আমার কাছে আছে।

মোরশেদা আরও বলেন, এভাবে হুমকি-ধামকির কারণে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ডিসির কাছে একটা দরখাস্ত দেই। সেখান থেকে অনুলিপি নিয়ে আমি থানার ওসিকে দেই। সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং উপজেলা চেয়ারম্যানকে দেই। এছাড়াও ওই কপি আমি আমার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকেও দেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয় নাই।

মোরশেদা বেগম অভিযোগ করে বলেন, কয়েকদিন আগে আলতাফ আমাকে বকুলতলা বাজারে একটি দোকানে ধরে নিয়ে গিয়ে বেইজ্জতি করে। আমার শ্লীলতাহানি ঘটায় এবং আমাকে বলে, টাকা দিতে। তখন আমি বলছি, কিসের টাকা দিবো। তখন সে বলে ভোটের টাকা। তখন আমি তাকে বলি, আমার ভোটটা ফেরত দে। আমার কোটি টাকার আমানত, পবিত্র ভোট তোকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলাম। আর তুই আমার কাছে কিসের টাকা ফেরত চাস। তখন সে আমাকে বলে, তুই টাকা দিয়ে ওঠেক। টাকা দিয়ে তারপর প্রধানমন্ত্রীকে বিচার দে।

এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে তিনি বলেন, তিনি আমার মা, আমি তার কাছে বিচার চাই। আমি কোনো উপায় না পেয়ে আপনাদের কাছে আসছি। আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। যেনো আমি সঠিকভাবে চলাফেরা করতে পারি। জনগণের কাছে যেতে পারি। আমি নির্বাচিত মহিলা মেম্বার। আমাকে জনগণ রাত ৩ টার সময়ও ডাকতে পারে। আমি এর আগেও দুইবার জনপ্রতিনিধি ছিলাম। এবার নিয়ে তিনবার আমি নির্বাচিত হয়েছি।

সংবাদ সম্মেলনে ৯নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মকবুল হোসেন সালাম বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর থেকেই মোরশেদা আপার এই দশা। তাকে নিয়মিত হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। কাপড় খুলে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে। আপা থানায় অভিযোগও করেছেন। কিন্তু থানা থেকে এখনও কেউ যায়নি। মুরশিদা আপা একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তার তিনটি ওয়ার্ডে ১০/১২ হাজার ভোট আছে। আমরা চাই না তাকে এভাবে বেইজ্জতি করা হোক। খারাপ ভাষায় গালি দেয়। এটা যেনো না হয়। তিনি যেনো পরিষদে এবং জনগণের কাছে নিরাপদে যেতে পারেন। তার নিরাপত্তার দাবি জানাচ্ছি আমরা।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য (কাউনিয়া) আলতাফ হোসেন।

তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভুয়া। ওনার সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তিনি আমার মামি হন। তার সাথে আমার জমি নিয়ে ঝামেলা আছে। সেটা নিয়ে পারিবারিক বিরোধ নিয়ে অনেক ঘটনাই তার সাথে ঘটেছে। তিনি এখন যে অভিযোগগুলো তুলছেন সেগুলো পারিবারিক বিরোধের জেরে ভোটের অনেক আগে হয়েছিল।

আলতাফ আরও বলেন, তিনি (মোরশেদা) যদি গৃহবন্দি থাকতেন, তাহলে রংপুর গিয়ে কীভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। তিনি তো কাউনিয়ায় বা বাড়িতে করতে পারতেন। তাহলে কি তাকে পুলিশ এসকর্ট নিয়ে গেছে নাকি সাংবাদিকরা এসকর্ট দিয়ে নিয়ে গেছে।

ওয়ার্ড মেম্বারদের টাকা দেয়ার ব্যাপারে তিনি সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার কীভাবে ভোট হয়েছে সেটা সাংবাদিকরা ভালোমতোই জানেন। অন্যরাও যেভাবে ভোট খেলেছে আমিও সেভাবে ভোট খেলেছি ভাই।

জেলা পরিষদ নির্বাচনে আলতাফের নিকটকম প্রতিদ্বন্দ্বী গোলাম সারোয়ার আনছারী জানান, মোরশেদা বেগমের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আলতাফ হোসেন টাকা দিয়ে ভোট কিনে নির্বাচিত হয়েছেন। যা অবৈধ। তাই ভোট বাতিল করে পুনরায় ভোট গ্রহণের আহবান জানান তিনি।

এ বিষয়ে কাউনিয়া থানার ওসি মোনতাছের বিল্লাহ জানান, ভোটের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন মোরশেদা। সে অনুলিপি তিনি বিভিন্ন জায়গায়ও দিয়েছেন। তবে তাকে হুমকি-ধামকি ও দোকানে আটকিয়ে শ্লীলতাহানি ঘটানোর বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ তিনি করেননি। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই তদন্ত করে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিবো।

রিটানিং কর্মকর্তার অফিস জানিয়েছে, গত ১৭ অক্টোবর রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে ২নং ওয়ার্ডের সদস্য হিসেবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আলতাফ হোসেন (তালা) প্রতীক নিয়ে ৫২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. গোলাম সারোয়ার আনছারী বাবু হাতি প্রতীক নিয়ে ৪০ ভোট এবং টিউবওয়েল প্রতীক নিয়ে মিজানুর রহমান ১ ভোট পেয়েছেন।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply