রংপুরে কাউন্সিলর শিপলুকে কারাগারে প্রেরণ

|

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

সড়ক ও জনপদ বিভাগের জমি জাল দলিল করে বিক্রির মামলায় এক বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত এবং তিনটি মামলার ওয়ারেন্টভুক্তসহ ৮ মামলার আসামি গ্রেফতারকৃত রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং তাজহাট মেট্রোপলিটন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া আলম শিপলুকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত।

শনিবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে দেড়টায় রংপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আহসানুল হক রানার আদালতে তাকে তোলা হয়। সেখানে তার বিরুদ্ধে থাকা চার ওয়ারেন্টভুক্ত মামলার তিনটিতে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন এবং ১৮১/২২ নম্বর চাঁদাবাজি মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

জাকারিয়া আলম শিপলুর আইনজীবী মাহমুদুল হক সেলিম জানান, তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট থাকা তিন মামলায় আদালত জামিন মঞ্জুর করেছেন। আর একটি মামলায় শুক্রবার (৭ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জেলা ও দায়রা জজ আদালতে থাকার কারণে সেটির শুনানি করা সম্ভব হয়নি। সে মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

শুক্রবার (৭ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে গ্রেফতারের পর পুলিশের গাড়িতে না নিয়ে তাকে নিজ গাড়িতে করে কোতয়ালী থানায় নিয়ে আসা হয়। শনিবার (৮ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টায় কোতয়ালী থানার ওসি মাহফুজুর রহমানের নিজস্ব ব্যবহৃত সরকারি গাড়ির ডাবল ডেকার সিটে বসিয়ে তাকে আদালতে নেয়া হয়। আদালতে নেয়ার পর তাকে মেট্রোপলিটন হাজত খানায় রাখা হয় শিপলুকে। পরে তাকে আদালতে তোলা হয়।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন জানিয়েছেন, রংপুর সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাকারিয়া আলম শিপলুকে মামলার ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, বাড়ি নির্মাণে বাধা দেয়া, ভাঙচুর, মারপিট, চাঁদাবাজির অভিযোগে জিআর ২৪৪/২২ ও ১৮১/২২ টি এবং বিদ্যুৎ কোর্টের সিআর ৪০৫৪/২২সহ চারটি মামলার ওয়ারেন্ট ছিল।

পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও জানান, শুক্রবার (৭ এপ্রিল) রাত সাড়ে নয়টায় নগরীর বিনোদপুর এলাকার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে শিপলুকে। তার বিরুদ্ধে আরো একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়াও তিনি একটি মামলার এক বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ওয়ারেন্টগুলো আগেই আদালত জারি করলেও প্রক্রিয়াগতভাবে ওয়ারেন্টগুলো আমাদের কাছে না থাকায় তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে আদালত থেকে আদেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর রই তাকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

এর আগে, শুক্রবার (৭ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে পাঁচটায় জাকারিয়া আলম শিপলুর বিনোদপুরস্থ বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান পরিচালনা করে মেট্রোপলিটন পুলিশ। এক পর্যায়ে সেখানে নেয়া হয় সাঁজোয়া যানও।

অভিযানের খবর পেয়ে শিপলু বাহিনীর লোকজন তার বাড়ির সামনে এসে বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিয়ে অভিযান বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। এ সময় অনেককে মুখে গামছা ও কাপড় বেঁধেও অবস্থান নিতে দেখা যায়। তারা যমুনা টেলিভিশনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার করে। এ নিয়ে সেখানে উত্তেজনাও তৈরি হয়।

পরে রাত সাড়ে নয়টায় কাউন্সিলর শিপলু বাড়ির দোতলা থেকে নিচে নেমে আসেন। এরপর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়। তবে তিনি পুলিশের গাড়িতে করে না গিয়ে নিজের গাড়িতে করেই সেখানে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়াদের অধিকাংশই পেশায় টোকাই ও শিপলু বাহিনীর সদস্য। তারা সেখানে বিভিন্ন ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে পুলিশকে উত্তেজিত করার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু পুলিশ ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখে।

অভিযানে বাধা দেয়া প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা আবু মারুফ হোসেন জানান, অনেকেরই অনেক ফ্যান-ফলোয়ার থাকে। কাউন্সিলর শিপলু সাহেবের লোকজনও সেখানে জড়ো হয়েছিল। তবে তারা কোনো ফোর্স করেনি।

প্রসঙ্গত, গত শনিবার (১ এপ্রিল) যমুনা টেলিভিশনের ‘ক্রাইম সিন’ নামক অনুষ্ঠানে জাকারিয়া আলম শিপলু ও তার বাহিনীর জমি জাল দলিল করে বিক্রি, জালিয়াতি, জবরদখল, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, কবরস্থানের জমি বেদখল, মাদকে পৃষ্ঠপোষকতা এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে হলফ নামায় তথ্য গোপন করার বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদনের জেরে গত বুধবার (৫ এপ্রিল) ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও জাকারিয়া আলম শিপলু আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ করসপন্ডেন্ট সরকার মাজহারুল মান্নানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় নূর মোহাম্মদ ও শাফিউল ইসলাম শাফি নামের আরো দু’জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে নূর মোহাম্মদের কাছেই শিপলু ও তার দুই সহযোগী জহরুল আলম শাহীন এবং খায়রুল ইসলাম রাসেল সড়ক ও জনপদ বিভাগের জমি জাল দলিল করে রেজিস্ট্রি বায়না করেছিলেন। এ বিষয়ে নূর মোহাম্মদ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। এ মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি শিপলুসহ তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে এক বছরের কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন রংপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ওই মামলায় সাজাবৃদ্ধির জন্য হাইকোর্টে আপিল করেন আওয়ামী লীগ নেতা নূর মোহাম্মদ। এছাড়াও অপর আসামি শাফিউল ইসলাম শাফি ওই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় শিপলু দাবি করেছেন, উপরোক্ত তিনজনের যোগসাজশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই ওই প্রতিবেদন করা হয়েছে। আদালত দাখিল হওয়া মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মামলা গ্রহণ কিংবা গ্রহণ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিবেন আদালত।

যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সরকার মাজহারুল মান্নান জানান, সুস্পষ্ট নথিপত্র ও হয়রানির শিকার এবং ভুক্তভোগী মানুষ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য দিয়ে ‘ক্রাইম সিন’ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করে। শিপলু যে মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, সে তথ্যও প্রতিবেদনে প্রচার করা হয়েছিল। তাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে ক্রাইম সিনে প্রচারিত তথ্য সঠিক। তদন্ত করলে অন্যান্য উপস্থাপিত তথ্যসমূহও শতভাগ সঠিক হিসেবে প্রমাণিত হবে। সে কারণেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দাখিল করা মামলা খারিজ করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে, যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সরকার মাজহারুল মান্নানের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার আবেদনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে রংপুরের গণমাধ্যমকর্মীরা। মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে মামলাটি প্রত্যাহার কিংবা খারিজ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। সাংবাদিক নেতারা মনে করেন, গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার জন্যই অপরাধীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে মামলা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানি এবং তাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করারও আহ্বান জানান তারা।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply