তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন: বিএনপির জয়

|

মিশুক নজিব

২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১। বাংলাদেশের ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এদিন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দেশে প্রথমবারের মতো এই ভোটের লড়াই চলে। তবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সংবিধানের অংশ ছিল না। কিন্তু সবগুলো রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সম্মতি দেয়ায় তা হয়েছিল।

একানব্বইয়ের এই ভোট দিয়ে দেশে ফিরে এসেছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। তবে সেই প্রক্রিয়া সুসংহত হয়নি বলে মত বিশ্লেষকদের।

ভোটের প্রেক্ষাপট:

নব্বই পেরিয়ে একানব্বইয়ের শুরু। সেই সময়েই হয় ৫ম সংসদ নির্বাচন। তখনও মানুষের মধ্যে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের রেশ বিরাজমান। আর সেই আন্দোলনের ওপর ভর করে ক্ষমতায় যায় বিএনপি। জেনারেল এরশাদের সঙ্গে বিএনপির আপস না করা এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যে ছাত্রদলের ভূমিকা দলটিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রেখেছিল।

তারও আগের কথা। আশির দশকের শুরুতে বিএনপিকে হটিয়ে মসনদে আসেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যা মেনে নেয়নি বিএনপি। তাই এরশাদের বিরুদ্ধে বিএনপির মনোভাব ছিল একরোখা। তার আমলে অনুষ্ঠিত দুটি ভোটেই বিএনপি অংশ নেয়নি। বিপরীতে দেশের আরেক বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ’৮৬ এর নির্বাচনে যায়। তবে সেই অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি দলটির জন্য। তাই আটাশির নির্বাচনে অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগ।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন ঘিরে একই টেবিলে বসেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা। দুই দলের মধ্যে দূরত্বও ছিল না আজকের মতো। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে উঠে ক্ষমতা।

নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন। অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ। এজন্য অবশ্য শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালন শেষে তাকে আবার নিজ কাজে ফিরে যেতে দিতে হবে। সব দল তাতে সম্মতি দিলে একইসঙ্গে শাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপ্রধান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। তার অধীনে এই নিরপেক্ষ সরকারের আকার ছিল ১৮ সদস্য বিশিষ্ট।

৫ম সংসদ নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি আবদুর রউফ। তিনি দেশের ৫ম সিইসি ছিলেন। ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। এই পদে থেকেছেন ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫ পর্যন্ত। তবে তার অধীনে এই ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়নি।

এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ’৯০ এর ১৫ ডিসেম্বর। সে সময় সিইসি ছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। তিনিই প্রথম সিইসি, যার অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

ফলাফল:

তফসিল ঘোষণার পরই ভোটের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। প্রধান দুই দলসহ এতে প্রায় সব দলই অংশ নেয়। বিএনপির নেতৃত্বে সাতদলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দলীয় জোট এবং বামপন্থী পাঁচ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়। জোটগুলো এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল।

একানব্বইয়ের ২৫ ফেব্রুয়ারি এক জনসভায় নৌকা হাতে শেখ হাসিনা। ছবি: গেটি ইমেজেস।

আওয়ামী লীগ সেইবার জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। যা ফুটে ওঠে সে সময় নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে। এছাড়া, দলের ইশতেহার ঘোষণার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করবেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে ৭২ এর সংবিধান পুনর্বহালের মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম করবেন।

১৯৯১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। ছবি: গেটি ইমেজেস।

অপরদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভোটের প্রচারে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি যেমন দিয়েছেন, তেমনি আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নানা ‘সতর্কবার্তা’ উচ্চারণ করেন। ভোটের আগে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা, অন্যদের হাতে গোলামির জিঞ্জির।

এ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, জামায়াতে ইসলামী ১৮টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) পাঁচটি, জাসদ (সিরাজ) একটি, ইসলামী ঐক্যজোট একটি, সিপিবি পাঁচটি, ওয়ার্কার্স পার্টি একটি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) একটি, গণতন্ত্রী পার্টি একটি ও ন্যাপ (মোজাফফর) একটি আসন পায়। তিনটি আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

তাতে সরকার গঠনের জন্য কোনো দলই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পরে বিএনপিকে সমর্থন দেয় জামায়াতে ইসলামী। আর দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে বিএনপি। দলটির নেতা খালেদা জিয়া সংসদ নেতা নির্বাচিত হন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পায় প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

এই সংসদের মেয়াদ ছিল চার বছর আট মাস। বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে বসেছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলটি তবে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি। অভিযোগ তোলে সূক্ষ্ণ কারচুপির।

তবে, দলটির পরাজয়ের কারণ নিয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা ড. কামাল হোসেনের একটি চিঠি ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় দেয়া এক চিঠিতে তিনি বলেন, অতি-বিশ্বাস, আত্মম্ভরিতা এবং কর্ম-বিমুখতার কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয়েছে। ভোটের আগেই বিজয় সম্পর্কে তারা অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সেজন্য নেতাকর্মীরা নিশ্চিত বিজয়ের আগাম গর্বে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।

তিনি আরও লেখেন, ডানপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো আওয়ামী লীগকে ভারতের সেবাদাস এবং ধর্মের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে যেভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে, তার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের প্রচারণা বরাবরই দুর্বল ছিল।

কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষারত ভোটারদের লাইন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

সামরিক শাসন অবসানের পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে এসেছিল। কোথাও তেমন গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেনি। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ৬ কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার ৭৪৩ জন। এর মধ্যে ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৩ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। যা মোট ভোটারের ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply