মেসিই কি সর্বকালের সেরা ফুটবলার?

|

আল মাহফুজ

‘লিওনেল মেসি সবকিছু এতো সহজে করে, যা আমি আগে কখনোই দেখিনি। এককথায় মেসি এলিয়েন।’ মন্তব্যটা বার্সেলোনার কিংবদন্তি ক্যাপ্তেন কার্লোস পুয়েলের। তুর্কি ফুটবলার আরদা তুরানও মেসিকে নিয়ে নিজের মুগ্ধতা লুকোতে পারেননি। ফুটবল জাদুকরের নিপুণ জাদুতে এতোটাই বুঁদ হয়েছেন, এলএমটেনকে সাক্ষাৎ ‘ঈশ্বর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার বলা কথাটা শোনা যাক– ‘আমি কখনোই মেসির মতো কাউকে দেখিনি। সে ইশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতা। সে যখন মাঠে তার কাজগুলো করে, আমি দেখে আনন্দিত হই’।

সর্বকালের সেরা ফুটবলার নির্ধারণের মানদণ্ড কী হতে পারে? অর্থাৎ কোন্‌ কোন্‌ বৈতরণী পার হলে একজন ফুটবল খেলোয়াড়কে গ্রেটদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে? নিজের টিমকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করানো (এক বা একাধিকবার)? বড় টিমে কয়েক সিজন দাপটের সঙ্গে খেলা? টানা এক অথবা দেড় দশক অন্যান্য প্লেয়ারের (টিম মেম্বারদের তো বটেই) তুলনায় যোজন দূরত্বে এগিয়ে থাকা?

নাকি এইসব ক্রাইটেরিয়ার রাস্তা ধরে আপনি হাঁটেন না? যদি হাঁটেন, তাহলে পুসকাস-ক্রুইফ-প্লাতিনি-জিকো-রুমেনিগেদের কী নামে ডাকা হবে? আর যাদের কখনও বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ আসেনি (ডি স্টেফানো-জর্জ বেস্ট-ক্যান্টোনা), তাদেরই বা কী হবে?

লিওনেল মেসি ২০২২ বিশ্বকাপ জিততে না পারলে তিনি কি সর্বকালের সেরা হতেন না? যে অবিশ্বাস্য ফর্মে বছরের পর বছর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ফুটবল মাঠে রাজত্ব করলেন, শুধুমাত্র বিশ্বকাপের শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারেননি বলেই কি তাকে সর্বকালের সেরার কাতারে রাখা যাবে না? বলাই বাহুল্য, এই বিতর্ক চিরন্তন।

একদা আমি সেই স্কুলের বারান্দায় ছিলাম, যেখানের ছাত্ররা ‘গ্রেট ফুটবলারদের শ্রেষ্ঠত্ব ট্রফি বা বিশ্বকাপ দিয়ে মাপা যায় না’– তত্ত্বে বিশ্বাসী। তবু আমার মনে দ্বিধার খচখচানি ছিল। দ্বন্দ্বের মুখরতা ছিল। কিন্তু এখন, এখন আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি— লিওনেল মেসি ইজ দ্য বেস্ট!

২০২২ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে মেসি।

আসুন, একটু মিলিয়ে দেখি– কোন বৈতরণীতে মেসির উত্তরণ কেমন? কেমন পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে তিনি হলেন ফুটবলের সর্বেসর্বা?

ইম্প্রেশনের প্রেষণায়

প্রথমে আসা যাক ‘ইম্প্রেশন’ আলাপে। ধরা যাক, যে ফুটবলারকে কেউ শ্রেষ্ঠত্বের তালিকাতেই আনে না, তার প্রতি আপনার ব্যাপক ভালো লাগা অথবা আপনার বিচারে সেই সেরা। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির একান্ত ভালো লাগা-মন্দ লাগা (ইম্প্রেশন) নিয়ে বিচার করার ব্যাপারে আমি অনাগ্রহী। কোনো কিছু দ্বারা কারও ভালো লাগাকে শর্তারোপ করে দেয়াটা আমার কাছে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’-এর মতো মনে হয়।

ভালো লাগা-মন্দ লাগার এই সাব্জেক্টিভ ম্যাটার নিজে যেমন সহজে গ্রহণ করতে পারি, তেমনি অন্যকেও গ্রহণ করতে উৎসাহিত করি। ফলত, কারো কাছে যদি জর্জ উইয়াহ বা এরকম কেউ ‘সর্বকালের সেরা ফুটবলার’ হিসেবে বিবেচিত হয়, আমি তার এই বয়ানকে রিফিউট করতে চাই না। এটা তার ইম্প্রেশনেই সীমাবদ্ধ থাক। কোনো ক্ষতি নেই তাতে।

পরিসংখ্যান প্রেক্ষিতে

এরপর আসা যাক ‘পরিসংখ্যান’ প্রেক্ষিতে। আর্জেন্টাইন জাদুকরের সাফল্যের মুকুটে কয়টি পালক এবং সেগুলো কী কী, তার একটা স্বল্প ফিরিস্তি দেয়া যাক। ১০টা লা লিগা, ৭টা কোপা দেল রে, ৭টা স্প্যানিশ সুপার কাপ, ৪টা উচল (উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ), ৩টা উয়েফা সুপার কাপ, ৩টা ক্লাব বিশ্বকাপ, রেকর্ড ৮টা ব্যালন ডি’অর, রেকর্ড ৬টা ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট, ১ ক্যালেন্ডার বর্ষে ৯১ গোল, ১টা অলিম্পিক, ১টা কোপা (এবার পেলে হবে ২টা), ১টা বিশ্বকাপ, রেকর্ড ২ বার বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল!

এছাড়া, সব মিলিয়ে মেসির রয়েছে ৮৩৫ গোল, যার মধ্যে হ্যাট্রিক ৫৭টা ম্যাচে। এইসব অর্জন লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হওয়ার যোগাড়। তবু মেসির সাফল্য-গাঁথার কথা কি ফুরোনো সম্ভব?

লজিক লকেটে

তারপর ‘লজিক’ লকেটে পথ এগোক। ক্যারিয়ারে ২৫ শতাংশ ম্যাচ ভালো খেলতে পারলেই গ্রেটদের কাতারে নাম ওঠানো যায়– এরকম এক ‘কন্ডিশনাল ন্যারেটিভ’ পোক্ত আছে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মাঝে।

এক্ষেত্রে লিওনেল কী করেছেন, জানেন? মেসির আসল ‘মেসি’ হয়ে ওঠা ২০০৯ সাল থেকে। তখন থেকে ধরলে ২০২২ বিশ্বকাপ পর্যন্ত প্রায় ছয়শত ম্যাচ খেলে তার ঝুলিতে ৩১০-এর মতো ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার! মানে এ সময়টাতে তার ভালো খেলার হার ৫০ শতাংশের বেশি (যা দুনিয়ার আর কারও নেই)। ‘ম্যাচসেরা’ হওয়া ছাড়াও তার ভালো খেলার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে।

ফুটবলের আকাশে মেসি কি সূর্যের রোশনাই? ছবি: বিবিসি

গ্রেটদের কাতারে থাকতে গেলে নাকি শুধুমাত্র গোল করতে জানলেও হয়। আর ‘গ্রেটেস্ট’ হতে গেলে শুধু গোল করলেই চলে না, প্লে মেকিং অ্যাবিলিটি, অ্যাসিস্ট-প্রি অ্যাসিস্ট নাম্বার, ক্লাব ক্যারিয়ার, ন্যাশনাল ক্যারিয়ার, ম্যান অব দ্য ম্যাচ ইত্যাদি অনুষঙ্গ আলোচনায় ঘুরেফিরে আসে।

একজন প্লেয়ার তার ক্যারিয়ারে যা যা পাওয়ার, লিওনেল মেসি তার চেয়েও বেশি পেয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন। ‘এলএম টেন’ বছরের পর পর একই কাজ করে যাচ্ছেন কী অসামান্য দক্ষতায়! শুধু ঝুলিতে ছিল না একটা বিশ্বকাপ, সেটাও অবশেষে অর্জিত হলো।

১৯৮৬ তে দিয়েগো ম্যারাডোনা যেভাবে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, ২০২২-এ মেসি তার চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। ছিয়াশির আসরে ‘ফুটবল ঈশ্বর’-এর ছিল ৫ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট অর্থাৎ দশ গোলে সম্পৃক্ততা। ছত্রিশ বছর পর মেসিও ঠিক ম্যারাডোনার মতোই দশ গোলে সম্পৃক্ত থেকেছেন (৭ গোল, ৩ অ্যাসিস্ট)। গোল্ডেন বল পাওয়ার ক্ষেত্রে লিও এগিয়ে রইলেন ম্যারাডোনা থেকে।

পরিশেষে আবারও বলি— ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ ধারণাটাই সাবজেক্টিভ বা রিলেটিভ। এটা কোনোভাবেই অব্জেক্টিভ বা বদ্ধমূল কিছু না। সুতরাং আপনার ওপিনিওন এক্ষেত্রে ভিন্ন হতেই পারে। তবে এইসব বিশ্লেষণ শেষে আমি বিশ্বাস করি— লিওনেল মেসি শুধু এই শতাব্দীর বেস্ট ফুটবলারই নন, মেসি হলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার! দ্য গ্রেটেস্ট অব অলটাইম!


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply