রাকিবুল ইসলাম মিতুল:
‘লিওনেল মেসি হ্যাজ শেকেন হ্যান্ডস উইথ প্যারাডাইস’ কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে লুসাইলের প্রেস বক্সে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার পিটার ড্রুরির সেই উক্তি এখনও কোটি কোটি আর্জেন্টাইন সমর্থকদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ড্রুরি কথাটা বাড়িয়ে বলেননি মোটেই। মেসি সেদিন হয়তো সত্যিই স্বর্গের দুয়ারে হাত রেখেছিলেন। সেই আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসির ৩৭তম জন্মদিন আজ।
১৯৮৭ সালে আজকের এই দিনে আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন তর্কসাপেক্ষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই ফুটবলার। জর্জ মেসি ও সেলিয়া কুচেত্তিনির সংসারের তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্ম নেন লিওনেল মেসি। এখন যে মেসির পায়ের জাদুতে মুগ্ধ পুরো বিশ্ব সেই মেসির শৈশবটা ছিল খুবই কঠিন। ১১ বছর বয়সে তার শরীরে গ্রোথ হরমোনজনিত জটিলতা দেখা দেয়। সমস্যা আরও বাড়ে কারণ তার বাবা মার চিকিৎসা করার সামর্থ্য না থাকায়। সেই চিকিৎসার জন্যই বার্সেলোনা পাড়ি দেয় মেসির পরিবার।
অসামান্য এই প্রতিভাকে নিজেদের একাডেমিতে নেয় বার্সেলোনা। মেসির চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি। মেসির সুপারস্টার হওয়াটা সেই বার্সাতেই ছিল বলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা স্পেনের এ শহরে নিয়ে যান তাকে। একাডেমি হয়ে মেসি ২০০৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্সেলোনা মূল স্কোয়াডে সুযোগ পান। এরপরের গল্পটা সবার জানা। ক্যাম্প ন্যু থেকে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু অথবা স্তদ দি ফ্রান্স থেকে ওয়েম্বলির সবুজে ছোট্ট দুটি পায়ে মেসি যা রচনা করেছেন, সেগুলোকে রূপকথা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! গত ২ দশকে ফুটবল শৈলীতে বিশ্বকে মোহিত করে রেখেছেন লিও।
জন্মদিনের শুভেচ্ছার পাশাপাশি চলুন দেখে যাক মেসির ক্যারিয়ারের চড়াই-উতরাই-
২০০৫ সালে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে তার গোলে শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দলটি। ২০০৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমেই পেয়েছিলেন গোলের দেখা।
২০০৮ সালে আর্জেন্টিনাকে অলিম্পিকের স্বর্ণ এনে দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই লিওনেল মেসির এমন দাপটে মুগ্ধ গোটা ফুটবল বিশ্ব। কিন্তু সেখানেই যে থমকে যাবে জাতীয় দলের জার্সিতে তার অর্জন তা কে ভেবেছিল? ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সাথে জুটি বেঁধেও সফল হতে পারেননি মেসি। শুরুটা ভালো হলেও কোয়ার্টার ফাইনালে শেষ সব স্বপ্ন।
এর মাঝে টানা ৪ বার ব্যালন ডি অর জিতে নিজেকে আরও পরিপক্ব করে তোলেন লিও। বার্সেলোনার জার্সিতে একের পর এক সাফল্য যেনো চুমু খাচ্ছিল ছোট জাদুকরের পায়ে। এরপর ঘুরে ফিরে আবার এলো বিশ্বকাপ। ফর্মের তুঙ্গে থাকা মেসি, এবার সব বাধা টপকে দলকে নিয়ে গেছিলেন শিরোপার একদম কাছে। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির কাছে আবারও হতাশা নিয়ে ফেরা।
বিশ্বকাপ হাতছাড়া হবার পর কোপা আমেরিকার টানা দুই শিরোপা হাতছাড়া হওয়ায় অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েন এলএম টেন। ক্লাবের জন্যই মেসি, জাতীয় দলের জন্য না, এমন দুয়োধ্বনিতে ভেঙ্গে পড়েন খোদ মেসিই। অবসরের ঘোষণা দেন জাতীয় দলের জার্সিতে। কিন্তু ফুটবলকে যিনি এতো দিয়েছেন, তাকে ফুটবল কিছু দেবে না তা কি হয়। কারণ ৫ ব্যালন ডি অর নাকি একটা বিশ্বকাপ এমন প্রশ্নে মেসি চেয়েছিলেন বিশ্বকাপটাই।
২০১৮ বিশ্বকাপে যখন বাছাই পর্বেই বাতিল হবার পথে আর্জেন্টিনা, তখন অবসর ভেঙ্গে ফিরে এসে দেখিয়েছেন তার জাদু। বাছাই পর্ব উতরে মূল পর্বের খেললেও ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের চাপটাই যেনো নিতে পারছিলেন না। পরের বছরের কোপা আমেরিকায় আবারও ব্যর্থ হলে শূন্য হাতে তার বিদায় যেনো নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালে ১৬ বছর পর জাতীয় দলের হয়ে তার শিরোপা জয়ের আক্ষেপ মেটে। কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপাটা যেনো তারই প্রাপ্ত ছিল।
২০০৬ থেকে শুরু, ২০১০ হয়ে ২০১৪, পেরিয়েছে ২০১৮ বিশ্বকাপও। চোখের নোনা জল বারবার হতাশার রেশ তুলে গেছে। তার বিরস নয়নে চেয়ে থাকা বলে যায় একের পর এক বিরহের কবিতা। কানে বাজে বাশির করুণ সুর।এরপরই আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ, ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে লিওনেল মেসির জাদুতেই ৩৬ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে আকাশি-নীল শিবিরে। সেই সাথে ‘অমরত্ব’ পেয়ে যান আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর।
বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ, আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল, ভিন্ন পাঁচ বিশ্বকাপে অ্যাসিস্ট, বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি মিনিট খেলা, সবচেয়ে বেশি গোল অবদানে মেসি একাই নিজের করে নেন কাতার বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপে ছুঁয়ে ফেলেছেন পেলেকে, সমান ১২ গোল করেছেন। করিয়েছেন সমান আট গোলও। নিজের শেষ বিশ্বকাপটাকে যে বেছে নিয়েছিলেন সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে। সেই দৌড়ে দ্বিতীয়বারের মতো তার হাতে উঠেছে বিশ্বকাপের সেরার তকমা। গোল্ডেন বলও ছিল তারই অপেক্ষায়। ক্যারিয়ারে কত কী অর্জন তার! শোকেজে ভরা ট্রফি। এমন হেন অর্জন নেই যেনো তার ডেরায় নেই। কিন্তু আক্ষেপ অপেক্ষা সবকিছুই যেন মিলেছিল এক বিন্দুতে। যে বিন্দু মহিরুহের মতো ছড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
সেই বিন্দু জমতে জমতে এক মহাসমুদ্রে রুপ নিয়েছে। যেই মহাসমুদ্রের একমাত্র নাবিক তিনি, যার হাতেই মানায় এই সোনালী ট্রফি, অবশেষে তার হাতেই উঠলো অধরা শিরোপাটা। এখন সপ্তামাকাশে উঠে গেছেন রোজারিওর ছোট্ট সেই বালক। পেয়েছেন অমরত্বের স্বাদ।
৩৬টি বসন্ত পেড়িয়ে ৩৭ পা দিলেন মেসি। বলতে গেলে ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বিকেলে এসে পড়েছেন ফুটবলের এ মহানায়ক। জন্মদিনে ফুটবল জাদুকরকে শুভেচ্ছা।
Leave a reply