ঘাটতি বাজেট কি? কেনো?

|

বাংলাদেশের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতির আকার ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল এক লাখ সাত হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। ঘাটতি বাজেট নিয়ে বিশ্বব্যাপী এর পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।

ঘাটতি বাজেট কী : প্রতি বছর সরকার বাজেটের মাধ্যমে জনগণের সামনে আয়-ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরে। এতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি থাকলে বাড়তি অংশই ঘাটতি বলে পরিচিত। এ ধরনের বাজেট ঘাটতি বাজেট। আবার আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ কম হলে যে অংশ উদ্বৃত্ত থাকে তা উদ্বৃত্ত বলে পরিচিত। এ ধরনের বাজেটকে উদ্বৃত্ত বাজেট বলে। তবে বাংলাদেশে আগে উদ্বৃত্ত বাজেট হলেও এখন ঘাটতি বাজেট হচ্ছে।

পক্ষের যুক্তি : আয় কম হলে জনগণের উন্নয়ন কাজের জন্য ব্যয়ও কম করা হয়। উন্নয়ন কাজে ব্যয় বাড়াতে তাই ঘাটতি বাজেট করা হয়। ঘাটতি অংশ সরকার ব্যাংক ঋণ, বৈদেশিক ঋণ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বা বন্ড বিক্রি করে ঋণ নেয়। ওইসব অর্থ বিনিয়োগ করে ঋণের সুদের চেয়ে বেশি অর্থ আয় করা সম্ভব হয় বলে ঘাটতি বাজেটকে লাভজনক ধরা হয়। ঋণ করে হলেও উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিলে এতে জনগণের উপকার হয়। এ কারণে অনেক অর্থনীতিবিদই ঘাটতি বাজেটের পক্ষে অবস্থান নেন।

বিপক্ষে যুক্তি : ঘাটতি অর্থায়ন ঋণ করে নিলে এর বিপরীতে সরকারকে সুদ দিতে হয়। ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে থাকলে ঋণের সুদের অঙ্কও বাড়তে থাকে। এক সময় সুদের অঙ্ক বাড়তে বাড়তে বাজেটকে ভারি করে ফেলে। ফলে বাজেটের বড় অংশই চলে সুদ পরিশোধে। এতে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রাও বেড়ে যায়। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যায়। এ কারণে অনেকেই ঘাটতি বাজেটের বিপক্ষে।

উদ্বৃত্ত বাজেট : যেসব দেশে কর জিডিপির অনুপাত বেশি সেসব দেশে উদ্বৃত্ত বাজেট করা সম্ভব। কিন্তু তারপরও এ রকম অনেক দেশই ঘাটতি বাজেট করে। কেননা তারা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বেশি নজর দেয়ার জন্য ঋণ নেয়। এতে উন্নয়ন কাজ বেশি হয়। ঋণ না নিলে উন্নয়ন কাজ কম হবে।

উদ্বৃত্ত বাজেট হলে ঋণ নিতে হয় না। ফলে বাজেটে সুদের চাপ থাকে না। এতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিও কম থাকে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ে।

প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ : বাংলাদেশে ঘাটতি বাজেট হয়। কারণে রাজস্ব আয় হয় কম। সরকারের অন্যান্য খাত থেকেও আয়ের পরিমাণ কম। যে কারণে উন্নয়ন কাজ বাড়াতে ঘাটতি বাজেট করা হয়। ঘাটতি অংশের বেশির ভাগই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেটানো হয়। আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিত। এখন তা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থকে বলা হয় ‘হাই পাওয়ার্ড মানি’ বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অর্থ। এগুলো বাজারে এসে দ্বিগুণ অর্থের সৃষ্টি করে। ফলে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে বিভিন্ন বন্ড বিক্রি করে ঋণ নেয় সরকার। এর বিপরীতে বিভিন্ন হারে সুদ দিতে হয়। এর জন্য অর্থবছরের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সিডিউল প্রণয়ন করে। এর আলোকে সরকার ঋণ নেয় ও পরিশোধ করে। দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বন্ড ছেড়েও সরকার ঋণ নেয়। এছাড়া সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয়, প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন বন্ড, প্রাইজবন্ড ও বৈদেশিক উৎস থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হয়। এসব ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না বলে সরকারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যে কারণে বাজেটে সুদের চাপ বাড়ে।

জিডিপির ৫ শতাংশ : দেশের ঘাটতি বাজেটের আকার বাড়লেও তা জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমিত থাকে। জিডিপির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাটতি বাজেটের আকারও বাড়তে থাকে। আগে ঘাটতি ছিল জিডিপির ৩ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৫ শতাংশে ওঠেছে। তবে বছর শেষে তা ৫ শতাংশের নিচেই থাকছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘাটতি বাজেট সম্পর্কে বলেছিলেন, ঘাটতির পরিমাণ বাড়লেও তা জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমিত। দেশের জিডিপির আকার বাড়ছে, এর সঙ্গে ঘাটতির পরিমাণও বাড়ছে। এতে দোষের কিছু নেই।

ঘাটতি বাজেটের স্বচ্ছতা : আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ঘাটতি বাজেট বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর জবাবদিহিতাও অনেক বেশি। ঘাটতির অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করা হবে, কোন খাতে ব্যয় হবে, এর বিপরীতে কি হারে সুদ দিতে হবে- এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকে। পরের বছর এগুলো ব্যয়ের ব্যাপারেও বিশদভাবে উল্লেখ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটি থাকে না। ঘাটতি বাজেট নিয়ে বাড়তি কোনো জবাবদিহিতাও নেই।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply