গাইবান্ধা প্রতিনিধি:
৯৯৯ ফোন কলের খেসারত হিসেবে এক নারীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের ধাপেরহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরির্দশক) নওয়াবুরের বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষকে দিয়ে বাড়ি ভাঙচুরের একটি মিথ্যা মামলার ফাঁদে ফেলে ওই নারীকে গ্রেফতারের পর আদালতে পাঠানোসহ পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে পরির্দশক নওয়াবুরের বিরুদ্ধে।
এছাড়া মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের ফলে চলতি ডিগ্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়েও ফলাফল এবং শিক্ষা জীবন অনিশ্চিতের আশঙ্কায় ভুগছেন বলে দাবি, ভুক্তভোগী নারীর।
এদিকে, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রতিকার চেয়ে অভিযুক্ত পুলিশ পরির্দশকের বিরুদ্ধে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রংপুর পুলিশ রেঞ্জ (ডিআইজি) ও গাইবান্ধা পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন শাম্মি আকতার নামের ঔই ভুক্তভোগী।
এরআগে, গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে ধাপেরহাটের পালানপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে ওই নারীকে আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে যায় ইনচার্জ নওয়াবুরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ। পরে নওয়াবুরের নির্দেশে মহিলা গ্রাম পুলিশ তাকে লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করে। এরপর প্রতিপক্ষকে দিয়ে পারিবারিক বিরোধের একটি মিথ্যা মামলার ফাঁদে ফেলে আদালতে পাঠায় পাঠানো হয় ঔই নারীকে।
নির্যাতনের শিকার ওই নারীর অভিযোগ, ভোর বেলা মহিলা পুলিশ নিয়ে তাদের বাসায় গেটে এসে ডাকতে থাকে ফাঁড়ির ইনচার্জ নওয়াবুর। গেট খুলে দিতেই নওয়াবুর জানতে চান, তোর বাপ-মা কোথায়, উত্তরে বলি বাবা-মা তো বাসায় নাই। তখন নওয়াবুর বলেন, তাহলে তুই চল ফাঁড়িতে। আমি জানতে চাই কেন, কোন অভিযোগ বা ওয়ারেন্ট আছে কি? তখন নওয়াবুর খারাপ ভাষায় গালি দিয়ে বলেন, ফাঁড়িতে চল তোর পাছায় ডিম ঢুকিয়ে বুঝিয়ে দিবো, কেন। এরপর শালি-শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়ে বলেন, তুই পুলিশের বিরুদ্ধে ৯৯৯ কল করিস, তোকে ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পাছায় ডিম ঢুকিয়ে দিয়ে দেখাবো, তোর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট। পরে বাসা থেকে জোর করে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় নওয়াবুর। সেখানে তার নির্দেশে তাকে লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করে এক নারী গ্রাম পুলিশ। এসময় বিভিন্ন অশ্লীল ভাষায় তাকে গালিগালাজ করে নওয়াবুর এবং বারবার বলতে থাকে, তুই ৯৯৯ কল করিস, তুই মাতব্বর হইসিস, তোকে আজ জেলের ভাত খাওয়াব। আমি বারবার অনুরোধ করি এবং আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি জানতে চাই। বাবা-মার সঙ্গে কার কি দ্বন্দ্ব তা আমি জানিনা, পরীক্ষা দিতে ঢাকা থেকে বাসায় আসছি। দুপুর ২টায় পরীক্ষা আছে, আমাকে ছেড়ে দিন বলে, বারবার আকুতি জানাই। পরে পা ধরে বলি আমার পরীক্ষা আছে, আমাকে পরীক্ষা দিতে দিন। কিন্তু কোন কথাই শোনেনি নওয়াবুর।
তিনি আরও বলেন, ‘সকাল ১০টার দিকে তাকে সাদুল্যাপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ওসি স্যারকে সব ঘটনা খুলে বলি। পরবর্তীতে আমাদের প্রতিপক্ষ শংকার চন্দ্রকে থানায় ডেকে আনেন নওয়াবুর। এরপর শংকারের সাজানো মামলায় তাকেসহ বাবা-মা, বোন ও চাচাকে আসামি করা হয়। পরে তাকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। অনুমতি নিয়ে পুলিশ হেফাজতে পরীক্ষা দিতে যাই কেন্দ্রে। আধাঘন্টা পর পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষায় অংশ নিলেও ভালো লিখতে পারি নাই। পরীক্ষা দিতে ঢাকা থেকে বাবার বাড়িতে এসে মিথ্যা মামলার আসামি হতে হবে জানা ছিল না। ৯৯৯ কল করার অপরাধে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে লাঠি দিয়ে পেটায় এবং গালিগালাজ করেছে। পুলিশের এমন আচরণ ও কর্মকাণ্ডের ফলে নিজের ও পারিবারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ এবং শিক্ষা জীবনে প্রভাব পড়ছে’। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার, ও মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার দাবিতে পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। সুষ্ঠু তদন্ত করলে ঘটনার সত্যতাসহ প্রতিপক্ষের সঙ্গে নওয়াবুরের সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তাই দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত পুলিশ পরির্দশক নওয়াবুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি’।
নির্যাতনের শিকার ওই নারীর বাবা সাজু প্রামাণিক বলেন, ‘জমি নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে ভাইসহ প্রতিবেশী শংকার চন্দ্রের সঙ্গে। এ নিয়ে আদালতে মামলাও আছে। প্রতিপক্ষ ফাঁড়ির ইনচার্জ নওয়াবুরের সঙ্গে সখ্যতা করে বিভিন্ন সময় হুমকি ও বাসাবাড়ি দখলের চেষ্টা করেন। ঘটনার দিন ৪ সেপ্টেম্বর সকালে প্রতিপক্ষ শংকার চন্দ্র সাহা ও শরিফুল প্রামাণিক গংরা সংঘবদ্ধ হয়ে লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের বাড়িতে হামলা করে। এসময় বাড়ির পাকা-টিনের ঘর, রান্না ঘর আসবাবপত্র, বাথরুম ভাঙচুর ও উঠানের বিভিন্ন গাছপালা কর্তন এবং লুটপাট করে তারা। একই সঙ্গে বসতি জমি দখলে নিয়ে ইটের প্রাচীর নির্মাণ করে। অথচ ফাঁড়ির ইনচার্জ নওয়াবুরকে প্রভাবিত করে প্রতিপক্ষ ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে উল্টো তাদের বিরুদ্ধে বাড়ি ভাঙচুরের মিথ্যা মামলা করেন প্রতিপক্ষ শংকার চন্দ্র।
সাজু প্রামাণিকের অভিযোগ, মামলায় স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ভাইকে আসামি করা হয়। আসামির মধ্যে এক মেয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকেন চট্রগ্রামে আর এক মেয়ে ঢাকা থেকে বাসায় আসছে পরীক্ষা দিতে। পারিবারিক দ্বন্ধের ঘটনা মেয়েদের জানা না থাকলেও প্রতিহিংসায় তাদের মামলায় আসামি করা হয়। এছাড়া বাসায় থাকা ছোট মেয়ে শাম্মিকে পুলিশের ইনচার্জ তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর, গালিগালাজসহ নির্যাতন করেন। মূলত প্রতিপক্ষের কাছে নওয়াবুর প্রভাবিত হয়ে মেয়েকে তুলে নিয়ে নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় হয়রানী করছেন। ঘটনার পর থেকে পুলিশের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও প্রতিপক্ষের নানা হুমকিতে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন বলেও অভিযোগ সাজু মিয়ার’।
এদিকে, নওয়াবুর ফাঁড়িতে যোগদানের পর থেকে আটক বাণিজ্যে ও মাদক ব্যবসায়ীসহ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িতদের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে ধাপেরহাটের একটি বাড়িতে ঢুকে ফাঁড়ির পুলিশ ভিডিও করছিলো। ভিডিও করতে বাড়ির মালিক ব্যবসায়ী ও যুবলীগ নেতা পলাশ বাঁধা দেয়। পরে খবর পেয়ে ইনচার্জ নওয়াবুর পলাশ ও তার বাবাকে আটক করে ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে মারধর করে। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী ও নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ফাঁড়িতে গেলে নওয়াবুর তাদের দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে তিনি ৩-৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। পরে এ ঘটনার প্রতিবাদ ও নওয়াবুরের অপসারণ দাবিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বিক্ষোভ করে ব্যবসায়ীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা। পরে খবর পেয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে এখনো এ ঘটনায় চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে ধাপেরহাটে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত পুলিশ পরির্দশক নওয়াবুরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গলিগালাজ ও মারধরের কোন ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া ব্যবসায়ী পলাশকে হয়রানীর অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, পুলিশ কাজে বাঁধা ও গায়ে হাত দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন।
তবে অভিযোগের বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্তের কথা জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি মুঠোফোনে বলেন, গুরুত্ব সহকারে অভিযোগ খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে পরির্দশক নওয়াবুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
Leave a reply