মুরশিদুজ্জামান হিমু
এপার বা ওপার বাংলায় সমকালীন গানের জগতে বিচরণ যাদের, তারা অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করেন, পূর্বসূরি বলতে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র নাম। কারণ, ভালোবাসা, আবেগ, বিরহ, দ্রোহ… কী নেই তাদের গানে, যা আপনি সুর আর কথায় খোঁজেন?
শুরু থেকেই তাদের চলার পথটা ছিল প্রচণ্ড কণ্টকময়। অনেকেই অনেক কটু কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, হচ্ছে না। কেউ বলেছিলেন, চেঁচালেই গান হয় নাকি? কেউ আবার বলেছিলেন, কবিতায় একটু সুর বসানোর চেষ্টা করলেই কি গান হয়? কিন্তু শেষমেষ তো হয়েছে। শুধু হয়-ই নি, যা হয়েছে, তা ইতিহাস। যে ইতিহাস বাংলা গানের, আধুনিক সুরের, আধুনিক চেতনার।
কলকাতার এই ব্যান্ডকে নিয়ে সমালোচনা চলেছে বহুদিন। যারা করেছিলেন, পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন তাদের অনেকেই। আজ থেকে চার দশক আগে এই ব্যান্ডটি দেখতে পেয়েছিলেন ‘আজ’কে, মানে ‘এখন’কে। তাই মহিনের ঘোড়াগুলি কালোত্তীর্ণ। বহু বছর আগে যেমন ছিল, এখনও আছে, শত বছর পর হয়ত আরও সজীব হবে।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র পথচলা :
৭০ এর দশকে কিছু ছেলে ‘পাগলামো’করতো। মানে দেশকে পাল্টে দেয়ার চিন্তা আরকি। রাজনীতি করত। গানও গাইত। হুট করে তারা একদিন চিন্তা করল, সবাই মিলে ব্যতিক্রমী কিছু একটা করবে। যা দেশ-সমাজকে কোনো বিশেষ বার্তা দেবে। কিন্তু কী করবে তারা? লেখালেখি আর গান গাওয়া ছাড়া যে এরা পারে না তেমন কিছুই। ঠিক হল গানই করবে তারা। গানের মাধ্যমে তারা কথা বলবে, গানের মাধ্যমে ভালোবাসবে, গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাবে, গানের মাধ্যমে এগিয়ে নেবে মাতৃভূমিকে। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল একটি ব্যান্ড। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা।
শুরুটা হয়েছিল গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে। বলা যায় তিনি মূল উদ্যোক্তা। গৌতম চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও আরও ছিলেন তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস, অ্যাব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় ও প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়। তবে, শুরুতে ব্যান্ডের নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ছিল না।
নাম ঠিক করা নিয়ে আছে মজার মজার গল্প। প্রথম থেকেই শুরু করি।
একদিন তাদের কাছে একটি স্টেজ শো’র অফার এল। তারা ঠিক করল, শো’টা করবে। কিন্তু কী নামে পারফর্ম করবে? অ্যানাউন্সারকে তো কোনো একটা নাম বলতে হবে। স্টেজে উঠে ঘোষণা করবে, এবার আসছে ‘ওমুক’ব্যান্ড। তাই নাম ঠিক করা জরুরি।
প্রাথমিকভাবে বসে ব্যান্ড মেম্বাররা ‘সপ্তর্ষী’নামে পারফর্ম করবেন বলে ঠিক করলেন। কারণ, তাদের সদস্য সংখ্যা সাত জন। সেই শো’টা ভালোয় ভালোয় পার হল ‘সপ্তর্ষী’নামেই।
কিন্তু তাড়াহুড়ো করে ঠিক করা নাম মনে ধরল না কারো। সবারই মত, পাল্টাতে হবে ‘সপ্তর্ষী’নামটি। একেক জন একেক নাম প্রস্তাব করতে থাকল। কারোরই কোনো নাম পছন্দ হয় না। একজন মজা করে বলে উঠল, আমাদের ব্যান্ডের নাম হবে ‘গৌতম চট্টোপাধ্যায় বিএসসি ও সম্প্রদায়’। হো হো করে হেসে উঠল সবাই। কথা আর মজার ছলে তারা নিজেরা মাঝেমধ্যে নামটি ধরে ডাকতেনও।
একদিন সবাই রিহ্যার্সেলে বসেছেন। গান হচ্ছে, আড্ডা হচ্ছে। পাগলাটে টাইপ ছেলেগুলো গানের ফাঁকে কবিতাও পড়ত। ওইদিন রঞ্জন ঘোষাল কেন জানি জীবনানন্দ দাশ সমগ্র এনেছিলেন হাতে করে। কয়েকটি গান গাওয়ার পর বললেন, এখন কবিতা হবে। জীবনানন্দের কবিতা। বই খুললেন। পৃষ্টা উল্টিয়ে আবৃত্তি শুরু করলেন জীবনানন্দের ‘ঘোড়া’কবিতাটি।
‘আমরা যাইনি মরে আজো– তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়ঃ
মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।’
ব্যাস, কবিতাটি থেকে মাথায় ঢুকে গেল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’নামটি। প্রস্তাব করার সঙ্গে সঙ্গে সাগ্রহে সবাই তা গ্রহণও করল। কারণ তারা তো একেকটি ঘোড়া। টগবগিয়ে ছুটে চলা ঘোড়া। তাপস দাস ও প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্যগুলো দিয়েছিলেন।
জীবনানন্দের কবিতা থেকে ব্যান্ডের নাম নেয়ার আরও কারণ আছে। যখন গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা ব্যান্ড করলেন, তখন ব্যাপক জনপ্রিয় হেমন্ত বা মান্না দে’র মত শিল্পীরা। তাদের ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ঘরানার গান করেছিল মহীনের ঘোড়াগুলি। সবসময় যেহেতু অন্যরকম কিছু করার চিন্তা ছিল তাদের, তাই ব্যান্ডের নাম ঠিক করার জন্য রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা ওই ঘরানায় যাননি গৌতমশিষ্যরা। বেছে নিয়েছিলেন তখনকার ব্যতিক্রমী জীবনানন্দকে। এছাড়া তারা চেয়েছিলেন, কাজের সাথে মিলবে না, গানের সাথে মিলবে না, এমন এক নাম। অর্থাৎ, নাম শুনে কেউ যাতে না ভাবে, এটা গানের দল। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’নামটি বেছে নেয়ার সেটাও একটি কারণ।
এভাবেই শুরু হল একটি গল্পের। গানে গানে মনের খোরাক যোগানো গল্প।
(চলবে…)
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ
Leave a reply