সাগরের বিরুদ্ধে ‘এক সাগর’ অভিযোগ

|

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি:

কুড়িগ্রামে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে এস.এম সাগর নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তার দৌরাত্ম্য থেকে রেহাই পায়নি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীও। এছাড়াও গরীব, দুস্থ ও অসহায় বেশকিছু পরিবারকে চাঁদা দিতে বাধ্য করেছেন এই ব্যক্তি।

কুড়িগ্রামে জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পৌরসভা এলাকার হাসেম বাজারের সোবহান আলীর পুত্র এই সাগর। চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার আসামি সাগর বেশ কয়েকবার গণধোলাইয়ের শিকার হলেও কমেনি তার দৌরাত্ম্য।

সাংবাদিক পরিচয় পোক্ত করতে এস.এম সাগর নিজেই অনলাইন পোর্টাল খুলেছেন। নিরীহ যুবকদের সাংবাদিক বানানোর প্রতারণার নতুন ফাঁদ পেতেছেন। ‘স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪ডট কম’ নামের একটি পোর্টাল এখন হয়েছে চাঁদাবাজির হাতিয়ার। এছাড়াও দেশের স্বনামধন্য মিডিয়ার পরিচয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন অনৈতিক সুবিধা।

সম্প্রতি সরকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসে। এরমধ্যে জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় একটি অস্তিস্বহীন প্রতিষ্ঠান ‘এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউট’ নিয়ে জাতীয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনিয়মের বিষয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়। এই সংবাদের সূত্র ধরে মোটা অংকের বাণিজ্য করেন এস এম সাগর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নিয়ে প্রচারিত সংবাদের বিপক্ষে সংবাদ প্রকাশের জন্য মোটা অংকের টাকা দাবি করেন তিনি। এক পর্যায় সমঝোতা করে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গত ৩০ অক্টোবর এস.এম সাগর তার অনলাইনে ‘ভূরুঙ্গামারীতে এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউট নিয়ে প্রকাশিত মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেন।

সংবাদে জেলা শিক্ষা অফিসারের পদবি এবং নাম ভুলভাবে উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সাফাই গাওয়া বক্তব্য দেয়া হয়। সেখানে বলা হয় সরকার চারটি শর্ত পূরণ করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিও স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই চারটি শর্ত পূরণ করায় ভূরুঙ্গামারীর এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউটকে এমপিও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে তার অনলাইন থেকে সংবাদটি মুছে ফেলেন তিনি।

এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন, সাগর নামে কোনো সাংবাদিক আমাকে ফোন দেননি। এবং অনলাইন পত্রিকা স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪.কমের কারো সাথেই আমার কথা হয়নি। তারা আমার নাম ভুল ব্যবহারসহ তাদের মনগড়া মন্তব্য প্রচার করেছেন। সেটি আমার বক্তব্য ছিল না।

সরকারদলীয় এক ছাত্রনেতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় হুমকি-ধামকি দিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে সাগরের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামতের চেক সিন্ডিকেটের হাতে; উন্নয়ন কাজ বন্ধ’ শিরোনামে সংবাদ প্রচার করা হয়। এই সংবাদের সূত্র ধরে ফুলবাড়ি উপজেলার বালারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেন তিনি।

কয়েকজন শিক্ষক জানান, হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে তাকে বিদায় করেছি। জানা গেছে, নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার এমন কোনো স্কুল নেই যেখানে গিয়ে টাকা তোলেননি এই সাগর।

সাগর তার মতোই কয়েকজন সাংবাদিক নামধারীকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তাদের সাথে অনেক দলীয় প্রভাবশালী নেতার ছবি তোলা থাকে। অভিযোগ আছে, এইসব ছবি দেখিয়ে ভূরুঙ্গামারী উপজেলাসহ জেলার প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীতে সাগরসহ তার সিন্ডিকেট বাহিনী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ঝুট প্লাস্টিক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে অর্থ আদায় করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে সিনিয়র সাংবাদিকদের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেন রফিকুল ইসলাম।

চতুর এই চাঁদাবাজ রৌমারী উপজেলায় গিয়ে বেশ কিছু ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে ৫০ হাজার এবং রৌমারী শুল্ক স্টেশন বন্দরের সংবাদ প্রকাশের জন্য ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও সরকারের উন্নয়নের কাজে অনিয়মের অভিযোগ এনে চেয়ারম্যানসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অংকের টাকা দাবির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

নাগেশ্বরীতে বেসরকারি এনজিও ‘মহিদেবে’ গিয়ে প্রায় চা খাওয়ানোর জন্য ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন সাগর। না হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের ভয়ভীতি দেখান।

নাগেশ্বরীর ‘পদক্ষেপ’ এনজিওতে কয়েক বছর আগে ত্রাণের চাল বিতরণের সময় টাকা না হলে চালের বস্তা দাবি করেন। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা ধরে তাকে গণধোলাই দেন। সাম্প্রতিক সময়ে রৌমারীতে গিয়ে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের ভয়ভীতি দেখালে স্থানীয়রা গণধোলাই দিলে সেখান থেকেও পালিয়ে আসেন সাগর।

একাধিক নামী-বেনামী গণমাধ্যমের পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে সাগর ও তার সাগরেদদের বিরুদ্ধে। তার সিন্ডিকেটের সদস্য বাগভান্ডার এলাকার মশিউর রহমানে ছেলে আলতাফ হোসেন খন্দকার সাংবাদিক পরিচয়ে নাগেশ্বরী বাজারের ব্যবসায়ী মনছুর আলীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর আবারো তার কাছে ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। অতিষ্ঠ হয়ে ব্যবসায়ী মনছুর আলী গত ২৬ জুলাই সকালে নাগেশ্বরী থানায় একটি চাঁদাবাজি মামলা করেন। ওই দিন দুপুরে বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে সাগরকে আটক করে পুলিশ।

২০০৭ সালে র‌্যাব পরিচয়ে চাঁদা দাবি করায় কচাকাটা থানা পুলিশ সাগরকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়।

ভূরুঙ্গামারী প্রেসক্লাবের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, বর্তমানে গুটি কয়েক নামধারী সাংবাদিক সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজির কারণে প্রকৃত ও পেশাদার সাংবাদিকদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তারা অস্তিত্বহীন কিছুু মিডিয়ার কার্ড ঝুলিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করছেন। সাধারণ মানুষ সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ায় কোনো লিখিত অভিযোগ না করলেও মৌখিক অভিযোগ করছেন।

কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী পরিচয়ে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার প্রচুর অভিযোগ উঠছে। জেলা পুলিশ তাদের তালিকা চেয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মান সম্মানের ভয়ে অনেকে অভিযোগ করতে চান না। ফলে তাদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়ে গেছে। এ নিয়ে মানুষের সজাগ হওয়া উচিৎ। যেন পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীদের সম্পর্কে তাদের কাছে ভুল বার্তা না যায়। পাশাপাশি প্রশাসনের উচিৎ চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার।

এ ব্যাপারে স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪.কমের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থপনা পরিচালক এস.এম সাগরের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ভাই আমাকে আরেকবার সুযোগ দেন। আমার পেটে লাথি দিয়েন না। আমি আমার নিউজটা (ভূরুঙ্গামারীর এফএ এবং এফএ মহিলা আইটি ইন্সটিটিউটকে) ডিলেট করেছি। এই নিউজ আমি করি নাই। এটা ঢাকা থেকে করেছে রেজা ভাই। আমি কিছুই জানি না।

স্বাধীন-স্বদেশ প্রতিদিন ২৪.কমের ঢাকা অফিস বার্তা প্রধান এজি লাভলু’র সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ভাই আমি এই অনলাইনের কিছুই না। তারা আমারসহ বার্তা সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আরিফের নাম ব্যবহার করেছে। তাকে একাধিকবার বলার পরেও সে আমাদের নাম সরিয়ে দেয়নি। তাকে বহুবার আমি রাগারাগিও করেছি নাম ব্যবহারের কারণে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply