আলমগীর স্বপন:
চারদিকে যখন সব গেল গেল রব, তখন লাল মিয়ারা একটু ব্যতিক্রমই বটে। বলছিলাম, বগুড়ার রিকশাচালক লাল মিয়ার কথা। খবরটা অনেকেই জানে। আবার অনেকের অজানা। যাদের অজানা তাদের সকাশে পেশ করতে চাই সেই সরল ব্যতিক্রমী মানুষটির কথা। যুগের ট্রেন্ডে ঘটনাটি শুনে অনেকে অবশ্য তাকে, ‘বোকা মানুষ’ও বলতে পারেন।
ঘটনাটি গত ১৬ নভেম্বরের। বগুড়ার সাতমাথা এলাকার। সার ব্যবসায়ী রাজীব প্রসাদ সকাল ৭টার দিকে তার জলেশ্বরী এলাকার বাড়ি থেকে রিকশাযোগে সাতমাথায় গিয়েছিলেন। সে সময় তার ব্যাগে ২০ লাখ টাকা ছিল। কিন্তু রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার সময় টাকার ব্যাগ রেখেই নেমে পড়েন।
তিনি যে রিকশায় ২০ লাখ টাকাসহ ব্যাগ রেখে এসেছিলেন সেই রিকশার চালকই ছিলেন লাল মিয়া। কিন্তু কিসের কী? টাকা পেয়ে যেখানে তার চম্পট দেয়ার কথা, সেখানে তিনি লেগে গেলেন ২০ লাখ টাকার মালিককে খুঁজতে। ওদিকে এত টাকা হারিয়ে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় রাজীব প্রসাদের। ছুটে যান স্থানীয় থানায়। অতঃপর পুলিশের তৎপরতায় লাল মিয়া ও রাজীব প্রসাদের যোগাযোগ সম্ভব হয়। এতে লাল মিয়াও হাঁফছেড়ে বাঁচে।
পুলিশকে জানায়, তার বাসায় টাকা রাখা আছে। টাকা ফেরত দিতে সেও খুঁজছে ব্যবসায়ী রাজীবকে। অতঃপর ২০ লাখ টাকা বুঝে পান ব্যবসায়ী রাজীব। একজন রিকশাচালক, যার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’, তিনি যখন সততার এমন অনন্য নজির স্থাপন করছেন তখন আমরা স্যুট-টাই পরা মানুষেরা কী করছি?
আমরা আসলে কী করছি এর একটি রিপোর্ট বেরিয়েছে ঠিক সেই শুক্রবারেই। কাকতালীয় হলেও একই দিনে লাল মিয়া ২০ লাখ টাকা পেয়েও ফেরত দিয়েছিলেন। এবার আসা যাক ঘুষবিষয়ক সেই রিপোর্টে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ‘ট্রেস’ বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঘুষের ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করে। কোনো বিশেষ দেশে, কোনো কোম্পানির কাছে ঘুষ চাওয়া হয় কিনা বা ঘুষের সম্মুখীন হতে হয় কিনা- এর পরিমাপ করে সূচক নির্ধারণ করে সংস্থাটি।
তাদের গবেষণা ‘ট্রেস ব্রাইবারি রিস্ক মেট্রিক্স’ রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ‘ঘুষ দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাংলাদেশ।’ এ তো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনা।
সংস্থাটি বিশ্বের ২০০ দেশের তথ্য নিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৮। সূচকের নিম্নমানের দিক থেকে গত বছর ৭০ পয়েন্ট পেলেও এ বছর আরও খারাপ, ২ পয়েন্ট বেশি পেয়েছে।
এর অর্থ, গত বছরের চেয়ে ঘুষের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। বাংলাদেশি ও বাঙালি হিসেবে লাল মিয়ার জন্য সিনা টান টান থাকলেও এই গবেষণা রিপোর্টের ফলাফলে নিশ্চয়ই লজ্জাবনত হব আমরা।
তবে ঘুষ-দুর্নীতি যেখানে রীতি হয়ে গেছে, সেখানে লজ্জা পাওয়ারই বা কী আছে? চলতি দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে দেখছি একটি দলের সহযোগী সংগঠনের ‘পিয়ন’ বা ‘গ্লাস বয়’ কীভাবে কোটিপতি হয়েছেন? গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন।
প্রভাবশালী রাজনীতিক-আমলা-প্রকৌশলীকে শত কোটি টাকা ঘুষ বা কমিশন দিয়ে একজন ঠিকাদার কীভাবে একাই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় বখরা দেয়া ছাড়া কি ক্যাসিনো চলেছে? লাখ কোটি পাচারের যেসব খবর আসছে, ইথারে ভাসছে, তা কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর জানা ছিল না?
দুদক কি এসবের কিছুই জানত না? কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দিনের পর দিন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, কারা কীভাবে অর্থ পাচার করছে- এসব কি অজানা ছিল এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু এবং তালিকা ধরে র্যাবের অভিযানে কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর কেন দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের টনক নড়ল? এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে।
কিন্তু স্বাধীন ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক কি শুদ্ধি অভিযানের আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত না? সরকার একটি তালিকা করেছে, পোস্ট বক্সের মতো সেটি গ্রহণ করে এখন ব্যবস্থা নিচ্ছে দুদক? আসামিদের হাতকড়া পরিয়ে দুদকে আনছে, জিজ্ঞাসাবাদ করছে, মামলা করছে। অথচ এ তালিকা অনেক আগেই করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। কারণ যাদের এখন ধরা হচ্ছে তারা হঠাৎ করে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়াননি।
ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও টাস্কফোর্সের ধরিয়ে দেয়া তালিকা অনুযায়ী অভিযান চালিয়েছিল দুদক। টাস্কফোর্স তালিকা পোস্ট করেছে আর দুদক সেটি প্রকাশ করে বাহবা পেয়েছে তখন। সে সময় দায়িত্ব পালনকারী একজন কমিশনার সাক্ষাৎকারে সরাসরিই বলেছিলেন আমাকে।
সরকারি তালিকা ধরে অভিযানের ফল আখেরে ভালো হয় না। বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭-০৮ সালে আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের পরও দুর্নীতি কমেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি বেড়েছে। এমনকি দুর্নীতি কমাতে বেতন বাড়ানোর মতো সরকারের সাহসী পদক্ষেপেও কাজ হচ্ছে না।
দুদক আইনের ১৭(ক) ধারায় কমিশনের কার্যাবলি অংশে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ স্বউদ্যোগে বা ক্ষতিগ্রস্ত বা তাহার পক্ষে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দাখিলকৃত আবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান’ করা যাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেউ অভিযোগ করলে, পত্রিকায় বা টিভিতে দুর্নীতির খবর প্রকাশ বা প্রচার হলে, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ পাঠালে, তালিকা ধরিয়ে দিলে বা হটলাইনে ফোনে জানালেই কেবল দুদক যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
কিন্তু স্বউদ্যোগে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের তালিকা করে দুদকের ব্যবস্থা নেয়ার নজির কম। স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীরা আয়-ব্যয় ও সম্পদের তথ্য জমা দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা যায় অনেক প্রার্থীর সম্পদ পাঁচ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে।
তাদের সম্পদের তথ্য সঠিক কিনা বা কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন তা খতিয়ে দেখা হয় কদাচিৎ। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া এ ক্ষেত্রে উদাহরণ খুবই কম। আবার ক্ষমতাসীন দলের বা প্রভাবশালী হলে তো অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকা যায়।
দুদক যদি কারও পোস্টবক্স না হয়ে নিজেদের উদ্যোগে ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীদের মধ্য থেকে সন্দেহভাজনদের তালিকা করত, সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করত, অনেক আগেই ব্যবস্থা নিত, তাহলে শুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতারকৃতরা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে এত ফুলেফেঁপে উঠতে পারত না।
ক্ষমতাসীন দলেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতো না। নিজের দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারি দলকে অভিযান চালাতে হতো না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সরকারেরও করণীয় আছে। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি সহযোগিতা করলে দুদক নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকত না।
এক সময়ে নখদন্তহীন বাঘ বলা হলেও দুদক কিন্তু এখন আগের চেয়ে অনেক তৎপর। বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নিয়েই পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন। মামলার আগে-পরে সন্দেহভাজন কিংবা আসামিদের গ্রেফতারে অনেক ক্ষেত্রেই পিছপা হননি।
বেশকিছু ঘুষখোরকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে ফাঁদ পেতে। কিন্তু অভিযোগ আছে, এর প্রায় বেশিরভাগই চুনোপুঁটি। সপ্তাহ তিনেক আগে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের একটি প্রতিনিধি দলও বড় দুর্নীতিবাজদের ধরা হচ্ছে কিনা- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
আজ ২১ নভেম্বর দুদকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরেও ‘রুই কাতলা’ দুর্নীতিবাজদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার অভিযোগ থেকেই গেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে মামলা, গ্রেফতার, চার্জশিট, বিচার হবে; কিন্তু এর অভিঘাত তেমন একটা পড়বে না রাষ্ট্রে-সমাজে। এ ক্ষেত্রে দুদকের কাজের ধরন ও পদ্ধতি বদলাতে হবে।
সম্প্রতি দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা ভারতের দুর্নীতি তদন্ত সংস্থার (সিবিআই) একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তারা সিবিআই ও দুদকের কাজের ধরন, অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে পার্থক্য, ঘাটতি, সক্ষমতা ও শক্তি নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন।
এতে দেখা যায়, সিবিআইর নিজস্ব বিশেষজ্ঞ প্যানেল, ডিজিটাল ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার ও ফরেনসিক ল্যাব আছে। কিন্তু দুদকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল নেই। প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও অর্জন করতে পারেনি।
ভারতের লোকপাল ও লোকায়ত আইন ২০১৩-এর ৪৪ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী প্রতি বছর বার্ষিক সম্পদ বিবরণী দাখিল করে। সম্পদের তথ্য যাচাইয়ে সিডিআর বিশ্লেষণ করে সিবিআই। সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের ব্যয় চার ভাগে ভাগ করে অনুসন্ধান করে প্রতিষ্ঠানটি।
খাদ্যসামগ্রী-গ্রোসারি ও তৈজসপত্রে ব্যয়, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জ্বালানির ব্যয় বিবেচনা করে সম্পদের হিসাব নির্ধারণ করে। কারও যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা আয়ের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ বেশি সম্পদ পায়, মামলা করে সিবিআই।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। অথচ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী যদি নেয়া হতো এবং তা সঠিকভাবে যাচাই করা হতো তাহলে ঘুষের প্রবণতা অনেক কমে যেত।
তদন্ত, অনুসন্ধান, আলামত সংগ্রহ, যাচাই, প্রযুক্তির ব্যবহারসহ আরও কিছু বিষয়ে সিবিআইর চেয়ে পিছিয়ে আছে দুদক। এর ভিত্তিতে দুদকের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কিছু সুপারিশ করেছে সফরকারী টিমটি। এর মধ্যে ফরেনসিক ল্যাব ও মোবাইল ডাটা তথ্য যাচাই, কম্পিউটার হার্ডডিস্কের তথ্য যাচাই ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছু অফিসারকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন ও ট্রাপ কেস পরিচালনার ক্ষেত্রে সিবিআইর প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সম্পত্তির অনুসন্ধান ও তদন্তে সিবিআইর কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করার সুপারিশও করা হয়েছে। অর্থপাচার কার্যকরভাবে প্রতিরোধে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সরকারের অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট পুনর্গঠনের প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।
তবে সিবিআইকে অনুকরণ নয়। সংস্থাটির ভালো দিকগুলো অনুসরণ করতে পারে দুদক। ভারতেও ক্ষমতাসীনদের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে সিবিআইর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সাবেক কংগ্রেস সরকারের এক অর্থমন্ত্রীকে গ্রেফতার নিয়েও সমালোচনায় পড়েছিল সংস্থাটি।
তবে সেখানে ক্ষমতাসীনরাও সিবিআইর নজরদারির বাইরে থাকে না। তবে দুদক চাইলেই বর্তমান কাঠামোতে সিবিআইর ভূমিকা নিতে পারবে না। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা করেই কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।
তবে দুদক শুধু ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের পোস্ট অফিস হবে এমন ভূমিকা কেউই চান না। লালমিয়ার মতো মানুষ যেন আরও তৈরি হয়, দুর্নীতি দমনে উদ্বুদ্ধ হয়, দুদকের এমন কর্মকাণ্ডই চান সবাই।
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন।
Leave a reply