দেশেই পেঁয়াজ উৎপাদন হয় প্রায় ৭৩ শতাংশ। আমদানি করতে হয় ২৭ শতাংশ। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করা হয় ভারত থেকে। অর্থাৎ মোট চাহিদার মাত্র ২১ শতাংশ আমদানি করা হয় দেশটি থেকে। অথচ দেশের পেঁয়াজের দাম ওঠানামা করে ভারতের বাজারের প্রভাবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় এ তথ্য মিলেছে। প্রতিযোগিতা কমিশনের জন্য ‘অ্যাসেজিং কম্পিটিশন ইন অনিয়ন মার্কেট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন বিআইডিএস’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ ও রিসার্চ ফেলো ড. মাইনুল হক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের দাম ওঠানামায় স্থানীয় বাজারমূল্য ও রফতানিতে ভারতের উচ্চ শুল্কারোপের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতে যখনই পেঁয়াজ রফতানি নিরুৎসাহিত হয়, বাংলাদেশের পেঁয়াজ বাজারে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়।
এছাড়া পেঁয়াজের দাম বাড়া-কমার পেছনে আরও চারটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হচ্ছে- উৎসব বা মৌসুমি চাহিদার কারণে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি, উৎপাদনের মৌসুম, সরবরাহে অভিঘাত এবং উৎপাদক ও ভোক্তারা যখন মজুদ করে রাখে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫-১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশেই পেঁয়াজ উৎপাদন হয় প্রায় ৭৩ শতাংশ। আমদানি করতে হয় ২৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। যেসব দেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলোর মধ্যে শুধু ভারত থেকে আমদানি হয় ৭৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
ভারতের পরই চীন থেকে আনা হয় মোট আমদানির ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়া থেকে শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশ, মিয়ানমার থেকে শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ, পাকিস্তান থেকে শূন্য দশমিক ০২ শতাংশ, সিঙ্গাপুর থেকে শূন্য দশমিক ০৫ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
এ কারণে ভারতে উৎপাদন কম হওয়া, শুল্কারোপ, বন্দরের জটিলতা ইত্যাদি বাংলাদেশে পেঁয়াজ বাজারে দ্রুত প্রভাব ফেলে।
জানতে চাইলে ড. নাজনীন আহমেদ বৃহস্পতিবার বলেন, আমরা যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করি, এর প্রধান অংশই আসে ভারত থেকে। সুতরাং দেশের পেঁয়াজের বাজারকে বড় ধরনের প্রভাবিত করতে পারে ভারত। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে হাতবদল হলেই পেঁয়াজের দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
যেমন কৃষক তো আর সরাসরি বাজারে আসতে পারেন না। এক্ষেত্রে যারা নিয়ে আসেন, তাদের পরিবহন ভাড়া, নানারকম চাঁদাসহ অন্যান্য খরচ থাকে। তাই এর প্রভাবে যে দাম বাড়ে, সেটিকে সিন্ডিকেট বলা যাবে না- এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
এদিকে বছরের এ সময়টায় এমনিতেই পেঁয়াজের কেজি ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে। কিন্তু সেখানে ২৫০ টাকা কেজি মেনে নেয়া যায় না। এজন্য আগে থেকেই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি ইত্যাদি বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।
ড. নাজনীন বলেন, আগে থেকে প্রস্তুতি থাকলে যখনই ঘাটতির শঙ্কা দেখা দেয়, তখনই যেসব দেশে পেঁয়াজ আছে সেখান থেকেই দ্রুত আমদানি করে দরিদ্র মানুষকে কম দামে সরবরাহ করা উচিত। তাছাড়া সাধারণ ক্রেতাদের স্বভাব হচ্ছে যখনই দাম বাড়ার শঙ্কা দেখা দেয়, তখনই সবাই পেঁয়াজ কিনে মজুদ করতে শুরু করেন।
ফলে বাজারে সরবরাহ ঘাটতি আরও বেড়ে যায়। এজন্য প্রতিবছর জুনে পেঁয়াজের বাজার নজর দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে উৎপাদন বাড়িয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৭২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। দেশি পেঁয়াজের একটি বড় অংশই জোগান দিচ্ছে পাবনা, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলা। ২০১৫-১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, পাবনায় পেঁয়াজ চাষ হয় ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, ফরিদপুরে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও রাজবাড়ীতে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।
এছাড়া রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলায়ও কিছু পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। বলা হয়েছে, ১০০ টাকার পেঁয়াজ বিক্রি হলে কৃষক পান ৪৩ দশমিক ৯ টাকা। অন্যদিকে কমিশন এজেন্ট ও আড়তদার পায় ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ অর্থ, বেপারি-ফড়িয়া পায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ, পাইকাররা পায় ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতারা পায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেদনটি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। তাছাড়া পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে মৌসুমে যখন পেঁয়াজের দাম কম থাকে তখন তা সংরক্ষণ করা উচিত। এজন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বাজারে কেউ একচেটিয়াভাবে দাম বাড়াচ্ছে কি না, যোগসাজশ করছে কি না বা কর্তৃত্বের অপব্যবহার করছে কি না- এসব বিষয় খেয়াল রাখা হচ্ছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের দামের আর একটি কারণ হচ্ছে উৎসব। কোনো উৎসব হলেই দ্রুত দাম বেড়ে যায়। তাছাড়া বন্দরগুলোতে যখন কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়, তখন কয়েকদিন সেখানে আটকা থাকলে পেঁয়াজের ওজন কমে যায়। ফলে আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়ে এই ক্ষতি পোষাতে চেষ্টা করেন।
বলা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ চেইন সংকুচিত হচ্ছে। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম হাত ঘুরে পেঁয়াজ ভোক্তার কাছে পৌঁছাচ্ছে। ফরিদপুরের পেঁয়াজ ভোক্তা পর্যায়ে আসতে হাতবদলের একটি চিত্র দেখানো হয়েছে গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে, উৎপাদক থেকে পেঁয়াজ চলে যায় ফড়িয়াদের হাতে। সেখান থেকে যায় বেপারিদের কাছে। বেপারিরা একই জেলায় বা অন্য জেলার বেপারি বা কমিশন এজেন্টদের কাছে পাঠিয়ে দেন পণ্যটি।
আমদানিকারকদের পেঁয়াজও চলে যায় কমিশন এজেন্টের হাতে। কমিশন এজেন্টের পেঁয়াজ পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের হাত ঘুরে যায় ভোক্তাদের কাছে। ঢাকার শ্যামবাজার, কারওয়ান বাজার ও মৌলভীবাজারে বেপারি ও কমিশন এজেন্টদের মধ্যে পেঁয়াজ হাতবদল হয় কয়েক দফায়।
Leave a reply