ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হচ্ছে। নগরীর সব এলাকায় নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি দিতে না পারার অভিযোগের মধ্যেই এ দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হল। এটি বাস্তবায়িত হলে ওয়াসার পানির বিলের বিশাল খরগ নগরবাসীর ওপর চেপে বসবে- এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, আবাসিক সংযোগে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির বর্তমান মূল্য ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ২০ টাকা। আর বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগে প্রতি হাজার লিটার পানির বর্তমান মূল্য ৩৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৬৫ টাকা।
অর্থাৎ আবাসিকে প্রতি হাজার লিটার পানির দাম বাড়ছে ৮ টাকা ৪৩ পয়সা এবং বাণিজ্যিক ও শিল্পে পানির দাম বাড়ছে ২৭ টাকা ৯৬ পয়সা। যেটা বর্তমান মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে ওয়াসার বাৎসরিক পানির গড় বিল করা হচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; সেটা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
আরও জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পানির বিলের সমান পয়ঃনিষ্কাশন বিল। এ জন্য পানির দাম দ্বিগুণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পয়ঃনিষ্কাশন বিলও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কাগজে-কলমে পুরান ঢাকা, ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকা, বাসাব-গেণ্ডারিয়াসহ আশপাশের এলাকা, গুলশান-বনানী-বারিধারা, মতিঝিল, মালিবাগ, সেগুনবাগিচা, মগবাজার এলাকা, দনিয়া-শ্যামপুরসহ আশপাশের ৮৮২ কিলোমিটার পয়ঃনিষ্কাশন লাইন এবং এর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ৬১ হাজার ৩৪৯ জন গ্রাহকের লাইন।
কিন্তু, বাস্তবে অধিকাংশ এলাকায় ঢাকা ওয়াসার পয়ঃসংযোগ লাইনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কেননা, দীর্ঘ সংস্কার না করায় এসব সংযোগ অকেজো হয়ে গেছে। এরপরও বর্তমান মূল্য অনুযায়ী ওয়াসা এসব গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। পানির সমান পয়ঃবর্জ্যে দাম বাড়ায় সেটা দাঁড়াবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা। তারা বলছেন, এখনও অনেক এলাকায় পানির সংকট ও পানিতে দুর্গন্ধ রয়েছে। সেসব সমস্যার সমাধান না করে ওয়াসা এভাবে পানির দাম বাড়াতে পারে না। এটা ওয়াসার যথেচ্ছাচার মনোভাবের প্রতিফলন। জনগণের মতামত বা সুবিধাকে তারা কোনোভাবেই প্রাধান্য দিচ্ছে না।
দাম বাড়ছে শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাজারীবাগের বাসিন্দা সাফায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ওয়াসার সরবরাহ নলে যে পানি আসে তাতে দুর্গন্ধ। এ কারণে বাড়তি বিল দিতে তার আপত্তি আছে।
শনির আখড়ার বাসিন্দা আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ নিত্যদিনের বিষয়। গত কয়েক দিন পানির অবস্থা খুবই খারাপ। ওয়াসার পানি কোনো কাজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। গত বছর অন্তত এক মাস এ অবস্থা ছিল। সেবার মান বাড়াবে না, কিন্তু টাকা বাড়াবে- এটা কেমন কথা!
এ প্রসঙ্গে পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকা ওয়াসা রাজধানীবাসীর অত্যাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কেননা, নোংরা ও দূষিত পানি সরবরাহ করছে এবং জোরপূর্বক পানির দাম বৃদ্ধি করছে। অন্যদিকে শহরের পয়ঃনিষ্কাশন সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়লেও পানির সমান দাম আদায় করছে ঢাকা ওয়াসা। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার পানির সংযোগ রয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৫১টি। এই সংযোগ থেকে এক কোটির বেশি মানুষ পানি ব্যবহার করে বলে ওয়াসার দাবি। ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ২০১৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের সময় আবাসিকে প্রতি হাজার লিটার পানির বিল ছিল ৫ টাকা ৭৫ পয়সা।
এরপর কয়েক দফায় সেই দাম বেড়ে আবাসিকে হয়েছে ১১টা ৫৭ পয়সা এবং বাণিজ্যিক ও শিল্পে হয়েছে ৩৭ টাকা ৪ পয়সা। ওয়াসার তথ্যমতে, ঢাকায় এখন দৈনিক পানির উৎপাদন ২৪৫ কোটি লিটার, যেখানে চাহিদা ২৩০ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার।
কাগজে-কলমে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি দেখানো হলেও বছরজুড়েই রাজধানীতে পানি সংকট থাকে। এ কারণে ওয়াসার প্রকৃত উৎপাদন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে নগরবাসীর।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা ওয়াসা নিজস্ব আয় দিয়ে সংস্থার পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। সে কারণে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। সবদিক বিবেচনা করে আমরা ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বৃদ্ধি করব- এমন একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু সেটা কত হবে; সেটা আমরা পরে জানাব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যুক্তিযুক্তভাবে সংকুলানের জন্য আবাসিকের প্রতি ১ হাজার লিটার পানির নতুন মূল্য ২০ টাকা এবং বাণিজ্যিকের প্রতি এক হাজার লিটার পানির মূল্য ৬৫ টাকা করার প্রস্তাব দেন।
স্থানীয় সরকার সচিব বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, ওয়াসা ঢাকা শহরের সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্টর্ম ড্রেনেজ (আংশিক) সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে ড্রেনেজ সেবার জন্য ওয়াসা কোনো মূল্য আদায় করে না গ্রাহকদের কাছ থেকে।
ওয়াসার পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য পানির মূল্য বৃদ্ধি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এরপর গত ১৪ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়- ওয়াসার ১ হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ, ওয়াসার ঋণ কত।
মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবে, গত ১৬ জানুয়ারি ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, ওয়াসার বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের ঋণ বাবদ ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে। এ ছাড়া প্রতি হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা পড়ছে বলে জানানো হয়।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চিঠিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন-১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ৬ নম্বর আইন)-এর ২২ অনুযায়ী পানির দাম বাড়ানোর অনুমোদন দিতে।
এ আইনে বলা হয়েছে- ‘(১) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সেবার জন্য আরোপিত অভিকর বা চার্জ প্রত্যেক বছর একবার বা বিশেষ কারণে যে কোনো সময় পর্যালোচনা করে দেখা হবে এবং প্রত্যেক পাঁচ বছরে অথবা তৎপূর্বে একবার সংশোধন করা যাবে, কিন্তু কোনো সংশোধিত অভিকর বা চার্জ সরকারের পূর্ব অনুমোদন ব্যতিরেকে আদায় করা যাবে না।
(২) উপ-ধারা (১)-এ যা বলা থাকুক না কেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাইলে অতিরিক্ত ব্যয় বহনের প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ, বোর্ডে অনুমোদনক্রমে, উক্ত অভিকর বা চার্জ প্রতি অর্থবছরে একবার অনধিক পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত সমন্বয় করতে পারবে।
(৩) পাঁচ শতাংশের অধিক মুদ্রাস্ফীতিজনিত অথবা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণে কর্তৃপক্ষের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে, উক্তরূপ ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার, লিখিত আদেশ দ্বারা, কর্তৃপক্ষকে উহার অভিকর বা চার্জের হার, সরকারের অনুমোদন ব্যতিরেকেই, বৃদ্ধি করিবার জন্য ক্ষমতা প্রদান করিতে পারবে।
Leave a reply