ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক প্রয়াত সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা বলেছেন, পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে স্বস্তি পেলেও কিংবা নিজে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তার মনে কোনো আনন্দ নেই। কারণ গত ২৪ বছর একটি অপবাদ তার জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। যদিও তিনি বর্তমানে স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করছেন। তবু যেখানেই যেতেন, মানুষের সন্দেহের চোখ তাকে পিষে মারত।
অভিনেতা সালমান শাহ ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান। তার মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি খুন- এ রহস্যের সন্ধানে কেটে গেছে বহুবছর।
অবশেষে সোমবার মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সংবাদ সম্মেলনে জানায়, সালমান শাহ পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেছেন। তার আত্মহত্যার বিষয়ে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তুলে ধরে পিবিআই।
এর মধ্যে অন্যতম নায়িকা শাবনূরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যদিও এ বিষয়ে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত শাবনূর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সামিরা যুগান্তরকে বলেন, এর আগেও চারবার বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইমন (সালমান শাহ) আত্মহত্যাই করেছে। আমিও একই কথা ১৯৯৬ সাল থেকেই বলে এসেছি। আমি জানতাম, পিবিআইও নতুন কিছু পাবে না। কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে ইমনের মা, ভাই ও কুমকুম মামা অপরাধী বানিয়ে রেখেছেন। মিথ্যে গল্প সাজিয়ে দেশবাসীর সামনে আমাকে খুনি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু সত্য কখনও লুকানো যায় না। অবশেষে সেটাই প্রমাণিত হল। এটাকে আমি ভালো লাগা বলব না। কারণ ইমন আমার স্বামী ছিল। ওর মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে তার আত্মহত্যার বিষয়টি প্রমাণ করেছে পিবিআই, এটাই স্বস্তির।
পিবিআইয়ের তদন্তে সালমানের আত্মহত্যার বিষয়টি প্রমাণ হলেও তার ভক্তরা কিন্তু সেটা মানতে নারাজ- এ ব্যাপারে সামিরা বলেন, ২৪ বছর আমি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছি। দীর্ঘ সময় পর নতুন করে সংসার শুরু করেছি, তিনটি বাচ্চা আছে আমার। মিথ্যা একটি অভিযোগের কারণে আমার পাশাপাশি তারাও হেয় হয়েছে। তাদের কাছে আমিও ছোট হয়েছি। পাশাপাশি ইমনের ভক্তরাও যে আমাকে অপছন্দ করত, এটাও জানি। এসব বিষয় আমাকে খুব কষ্ট দিত।
আবার কিছু ভক্ত ইমনের মা ও পরিবারের ষড়যন্ত্রের কথা জানত। অবশেষে সেটাই প্রমাণ হল। পিবিআইয়ের প্রতিবেদন প্রকাশের পর অসংখ্য ভক্ত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছে, সালমান যদি সত্যিই খুন হতো, তাহলে সেটা বারবার আত্মহত্যার প্রমাণ হয়ে প্রতিবেদনে আসত না। আমি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো ব্যক্তি নই, কিংবা আমার আর্থিক অবস্থাও এত বেশি নয় যে, পিবিআইয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নেব!
তিনি আরও বলেন, যেখানে সালমান ছিল একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং এটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। এসব বিষয় নিশ্চয়ই তার ভক্তরা বুঝতে পেরেছে। তাদের প্রিয় নায়ক আত্মহত্যা করেছেন, মানতে কষ্ট হলেও বাস্তবতা মেনে নেয়ার মানসিকতা নিশ্চয়ই তাদের আছে এবং নিচ্ছেনও। এটা আমার জন্য ভালো লাগার বিষয়।
এক প্রশ্নের জবাবে সামিরা বলেন, দেখুন, প্রত্যেকটি সংসারেই ঝুট-ঝামেলা থাকে। একটা সময় সেটা মিটেও যায়। আমি অস্বীকার করব না, সালমানের সঙ্গে আমার কখনোই ঝগড়া হয়নি। হয়েছে এবং সেটা তাৎক্ষণিক মিটেও গেছে।
এটা সত্যি, শাবনূরের সঙ্গে সালমানের একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। সে বাসায় আসত আমাদের, শুটিং স্পটে দেখা হতো। সব সময় সালমানকে ভাইয়া বলে ডাকত। তবে সে সালমানের সঙ্গে রিলেশনে যাবে, এটা আমি মানতে পারিনি। হোক সেটা একদিনের জন্য বা এক মুহূর্তের জন্য! স্বামীর প্রেমিকা আছে, এটা কোনো মেয়ে মানবে বলুন? এসব নিয়ে যখন মিডিয়ায় খবর প্রকাশ হচ্ছিল, তখন আমি খুব বিরক্ত হয়েছি।
একটা সময় শাবনূরের ওপর রাগও হয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে তার সঙ্গে কিছু বলিনি। শুধু সালমানকে সাবধান করেছি। সালমানও রাগ করত এসব শুনে। অনেকবার ঝগড়া হয়েছে এসব নিয়ে। আমি রাগ করে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছি কয়েকবার। সালমানই আবার বুঝিয়ে আমাকে শান্ত করে বাসায় নিয়ে আসত। কথা দিয়েছিল শাবনূরের কাছ থেকে সরে আসবে। সংবাদ সম্মেলন করে শাবনূরকে ছোট বোন বলে ঘোষণাও দিল। তার সঙ্গে ছবি না করার ঘোষণাও দিয়েছিল।
এরপর আবারও শাবনূরকে নিয়ে মাতামাতি করল। তার ভেতরে যে শাবনূরকে নিয়ে ইমোশন তখনও রয়ে গেছে, সেটা হয়তো আমি বুঝতে পারিনি। প্রচণ্ড ইমোশনাল ছিল সালমান। ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। সেটা পারেনি বলেই নিজেকে বলি দিল।
সালমানের মৃত্যুর পর অনেকটা মিডিয়ার আড়ালে চলে যান সামিরা। কয়েক বছর পর জানা যায় তিনি বিয়ে করেছেন। এরপর স্বামী, সন্তানসহ ছবিও প্রকাশ পায়। অনেকে বলেছেন, ঝামেলা এড়াতে স্বামী-সন্তান নিয়ে বিদেশে পালিয়ে আছেন তিনি। এ বিষয়েও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সামিরা।
তিনি বলেন, সালমানের পরিবার আমার নামে অনেক মিথ্যা রটিয়েছে। এটা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে। আমি কেন পালিয়ে যাব? আমি সব সময়ই দেশে ছিলাম, এখনও আছি; বরং তার পরিবারের কেউ দেশে নেই। সালমানের মৃত্যুর পর তার বিষয় সম্পত্তি নিয়ে দেশ ছেড়েছেন।
সালমানের মা ও ভাই লন্ডনে থাকে। মামা আলমগীর কুমকুম আমেরিকায় থাকেন। বিদেশে বসে তারা সালমান খুনের বিচার চান, ভক্তদের রাস্তায় নামিয়ে আন্দোলন করান। তাদের আবেগ নিয়ে খেলা করেন। আমি কখনও চাইনি মিডিয়ার সামনে কথা বলতে। আমি বিশ্বাস করতাম, একদিন সত্যিটা সামনে আসবে এবং এসেছেও। তাই মিডিয়ায় কথা বলার প্রয়োজন মনে করিনি।
সামিরা বলেন, আমি একজন নারী, যত বেশি কথা বলব, তত বেশি আমাকে নিয়ে কুৎসা রটানো হবে। এই যে এখন সবাই শাবনূরকে টেনে এনে সালমানের চরিত্র নিয়ে নানারকম সমালোচনা করছে। শাবনূরকেও আমি ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই। একটি কথাও বলিনি সালমান-শাবনূরের সম্পর্ক নিয়ে। শাবনূরকে নিয়ে একটা অভিযোগও তুলিনি।
কিন্তু তারা ছাড় দেয়নি। আত্মহত্যা জেনেও এটা নিয়ে নাটক বানিয়েছে, একবার দাফন করা লাশ আবার উঠিয়েছে। বারবার তদন্ত প্রতিবেদনে নারাজি দিয়ে একটা মৃত মানুষকে নিয়ে টানা-হেঁচড়া করেছে। শেষ পর্যন্ত তাকে সমালোচনার পাত্র বানিয়ে ছেড়েছে। এসব আমি কোনোদিনই চাইনি। আর চাইনি বলেই মিডিয়া থেকে দূরে ছিলাম।
আপনি বললেন, শাবনূরকে নিয়ে বিশেষ ইমোশন ছিল, যেটা সালমান ছাড়তে পারেনি, তার জন্য আপনি কী কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সামিরা বলেন, সালমান আমাকে বলেছিল, তাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে। শাবনূরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখবে। তার সঙ্গে কিছু কাজ বাকি আছে।
সেগুলো শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি যেন ধৈর্য ধরি। আমিও বিশ্বাস করলাম। মেনে নিলাম তার কথা। কিন্তু আসলে ধারণা ভুল ছিল। মৃত্যুর আগের দিন এফডিসিতে একটি ছবির ডাবিং ছিল। সালমান ডাবিং করছিল। আমি আমার শ্বশুরের সঙ্গে এফডিসি গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম শাবনূর সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। আমি এটা নিতে পারিনি। রাগ করে চলে এলাম। এরপর রাতে বাসায় এসে সালমান অনেক রাগারাগি করল আমার সঙ্গে। এরপরের ঘটনা তো সবারই জানা।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সালমান শাবনূরকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি কি তখন এ ব্যাপারে কিছুই টের পাননি? এর জবাবে সামিরা বলেন, এ ধরনের কিছু সত্যিই আমি তখন বুঝতে পারিনি।
তবে আমি একবার রাগ করলে সালমান আমাকে চট্টগ্রাম বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে এক ফাঁকে আমাকে বলেছিল, শাবনূর তাকে বিয়ে করতে চায়। আমি তখন কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম। আসলে সালমান কী চায়? এটা টের পেয়েছিলাম সালমান ও শাবনূরের মা- দু’জনেই এ বিয়ে নিয়ে আগ্রহী। বিশেষ করে আমার শাশুড়ি তো আমাকে কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি। আমাকে সালমান পাগলের মতো ভালোবাসত, এটা তার পছন্দ ছিল না। তাই আমাকে প্রতিপক্ষ ভাবতেন।
Leave a reply