বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার যদি হন সাকিব আল হাসান, তবে সবচেয়ে বড় আবেগের নাম অবশ্যই মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক ভালোবাসার নাম হয়ে আছেন তিনি। ইনজুরির কারণে তার একেকবার ছিটকে পড়া কাঁদিয়েছে অসংখ্য ভক্ত-সমর্থকদের। তবু কী অদম্য সাহসের সাথে ফিরে এসেছেন বারবার। তিনিই মাশরাফী। যিনি হেরেও লড়াইটা চালিয়ে যান। ফলে, চূড়ান্ত বিচারে হারেন না কখনোই। বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিলেন। জানালেন, শুক্রবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচই অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচ।
সংবাদ সম্মেলনে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। কখনো আবেগী, কখনো বা সচেতন স্মৃতিচারণ।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলো এখনো জ্বলজ্বলে তাজা স্মৃতি হয়ে আছে ম্যাশের মানসপটে। বলেন, যখন বাংলাদেশ টিম খেলে তখন হাজারো মানুষ তাকিয়ে থাকে। এতটা দিন খেলেছি মানুষের ভালবাসা নিয়ে, মানুষের নানা চাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে। এখানে অনেক একমত-দ্বিমত ছিল। আমাকে নানা চড়াই উৎরাই পার করে সেগুলো পাশ কাটিয়ে এ পর্যন্ত এগিয়ে আসতে হয়েছে। যে সহজে সব কিছু পায় তার কাছে কোনো কিছুর মূল্য থাকে না। আমি এত সহজে কিছু পাইনি বলে আমার কাছে এই প্রাপ্তি মহামূল্যবান। এই পর্যন্ত আসা আমার কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের ছিল।
অধিনায়কত্ব থেকে বিদায় নেয়ার বিষয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাসায় সবাইকে ফোন করে জানিয়েছি। তারা আমার পাশে আছে বলে আশ্বস্ত করেছেন। তারা আমার পাশে সেভাবেই থাকবেন ঠিক যেভাবে বাংলাদেশের মানুষ আমার পাশে ছিল। তারা আমার সিদ্ধান্তের সাথে অবশ্যই একমত।
মুশফিকের বিষয়েও কথা বলেছেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা বিজয়ের পেছনে মুশফিকের অবদান অনস্বীকার্য। বলাবাহুল্য, বিশ্বের অন্যতম ভালো প্লেয়ার মুশফিক। তাকে যাতে কোনো মানুষিক চাপের মাঝে না রাখা হয় সেটাই চাইছি। বিসিবির যদি কোনো ধরনের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষা থেকে থাকে তাহলে সেটা মুশফিকের সাথে আলোচনা করা উচিৎ।
ম্যাশ বলেন, আমি সবসময় আমার টিম মেম্বারদের সাপোর্ট পেয়েছি। অনেক মুহূর্ত আছে তাদের সাথে যা ভোলার মতো নয়। ওদের সাথে নিয়েই আমি মানুষের ভালোবাসার দ্বারে পৌঁছেছি। কোনো কিছুই আমার একার অর্জন নয়। তবে অনেক কিছুই ভেবেছি অবিশ্বাস্য, কিন্তু পেরেছি। আবার অনেক কিছু বিশ্বাস্য হয়েও হাতছাড়া হয়ে গেছে।
যোগ্য অধিনায়কের মতোই বিদায়বেলায় খেলোয়াড়দের সাপোর্ট করার আহ্বানই জানালেন ম্যাশ। বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত, যখন কেউ বাংলাদেশের জার্সি পরে নামে তার কাছে সবকিছু আর সহজ থাকে না। মিডিয়া, দর্শক, টেলিভিশনের পর্দাসহ বলতে গেলে পুরো দেশ তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। সেখানে ভুল করার কোনো অপশন নেই। যেটা হয় সেটা শত চেষ্টার বিরুদ্ধেই।
অপ্রাপ্তির বিষয়ে ভারতের সাথে ১ রানে হারার দিনটার কথা উল্লেখ করে মাশরাফী বলেন, সেদিনের কথা আমরা ভুলতে পারবো না। মনে আছে সেদিন সবাইকে দেখলাম হোটেলে এসে করিডোরে মন খারাপ করে বসে আছে। কেউ কারও সাথে না পারতে কথা পর্যন্ত বলতে চাচ্ছিলো না। আসলে ক্যাপ্টেন হিসেবে সবাই চায় জেতার জন্য। ম্যাচ হারলে সেটা আরও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আমি কখনোই সকাল থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আরামে কাটাইনি। এমন অপ্রাপ্তি প্রতিটা মানুষের মাঝেই রয়েছে।
টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ার দ্রুতই শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে কাউকে নিয়ে দোষ দিতে চান না ম্যাশ। বলেছেন, আমার খারাপ সময়ে যারা আমার সমালোচনা করেছেন তারা একদিন তাদের ভুল বুঝতে পারবেন। ১৫টা বছর যেখানে পার করলাম সেখানে আমার অনেক দায়িত্ব অবশ্যই রয়েছে। কে কি বলল এটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। আর এটা এখন আলোচনায় আসার মতও কিছু নয়।
সমালোচনার বিষয়ে কথা বলতে গিয়েও সংযত মাশরাফী। বললেন, আমার সামনে মাইক না থাকলে হয়ত আমার থলি খুলে যেত। যেটা না হওয়াই ভালো। এখানে একটা সময় পর্যন্ত সবাই সম্মান করে। প্রফেশনালিজমের দিক দিয়ে ভাবলে সমালোচনা করাটা অযৌক্তিক নয়। তবে পরিবার হলে তর্ক করা যায়, কিন্তু জার্সি পরে নামলে সব কথা বলা যায় না। কারণ সেখানে অনেক দায়বদ্ধতার বিষয় থেকে যায়। মিডিয়ার সামনে সবাই এসে গর্ব করে না, প্লেয়াররা চায় না, তাদের বড় করেন। তারা বলে না, ম্যাচ জেতার পরে আমার বাবা মাকে নিয়ে লাইভ করেন। কিন্তু ম্যাচ হারলে দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে যায়। কোনো প্লেয়ারই চায় না সবার সামনে তার ইমেজ খারাপ হোক। পুরো দেশ তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখুক। এখানে কেউ যখন ভাল খেলে সবাই ভাল বলে। আর খারাপ খেললেই সে ডিসিপ্লিনড না।
বিদায় বেলা অধিনায়কের দর্শন- জীবন যেখানে যেরকম। বললেন, আমার সব ক্রিকেট নিয়ে। যদি জীবনে ক্রিকেট প্লেয়ার না হতাম তবে অবশ্যই মাছের ব্যবসা করতাম। মাছের ব্যবসা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা।
এরপর, সাংবাদিক-ভক্তদের সাথে ছবি তুললেন। এক সময় মাঠের দিকে এগিয়ে গেলেন। সবাইকে ছেড়ে একা একা হেঁটে গেলেন অনেকটা দূরে। জীবনটাই এরকম। আড্ডা পাগল মাশরাফীকেও মাঝে মাঝে একা করে দেয়।
Leave a reply