তোয়াহা ফারুক:
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৭.৫ লাখের মতো হতে পারে- এমন শঙ্কার কথা উঠে এসেছে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে। ‘ইনফেকশন্স আর রাইজিং ফাস্ট ইন বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অধ্যাপক জন ডি ক্লেমেন্সের মতামতের ভিত্তিতে এমন তথ্য দিয়েছে সাময়িকীটি। ঢাকা শহরে আক্রান্তের এমন তথ্য নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। উদ্বেগ-শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। কেউ কেউ এর বিশ্বাসযোগ্যতাকেও করছেন প্রশ্নবিদ্ধ। পরবর্তীতে আইসিডিডিআরবি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছে, দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে ড. জন ডি ক্নেমেন্সের বক্তব্য যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান এ বিষয়ে যমুনা নিউজকে বলেন, তাদের এমন তথ্যের ভিত্তি না জেনে মন্তব্য করতে পারছি না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করেন। গ্রামে এখনও সংক্রমণ ব্যাপকহারে ছড়ায়নি। এটা সত্য শহরে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। কিন্তু সেই সংখ্যাটি এত বেশি বলে আমরা মনে করি না।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে দেয়া তথ্যের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন করলেও রাজধানীতে আক্রান্তের এমন শঙ্কাকে পুরোপুরিভাবে নাকচ করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পদ্ধতিগত গবেষণা ও জরিপের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সোয়াইন ফ্লু যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন একটা ফর্মুলা ছিল- ল্যাবরেটরিতে শনাক্ত যতজন রোগী পাওয়া যাবে তার বাইরে মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগী থাকবে কমপক্ষে ১০ গুণ আর সবোর্চ্চ ৪০ গুণ। তখন রিপ্রোডাকটিভ ফ্যাক্টর (এক জন থেকে গড়ে কতজন আক্রান্ত হতে পারে) ছিল ১.৫। করোনার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে এটি ২.৫। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই হার ১.২৫ আছে বলে আমরা মনে করছি। যদিও এটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরে ২০ হাজারের মতো করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। সে হিসেবে ১০ গুণ বেশি ধরলে ২ লাখের মতো এবং ৪০ গুণ ধরলে ৮ লাখের মতো দাঁড়ায় সংখ্যাটি। আমার মনে হয় মাঝামাঝি ধরে ২৫ গুণ হিসেব করলে যা দাঁড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা তেমন কিছু একটা হতে পারে (সে হিসেবে ৪ লাখের বেশি)। এটা একটা ফর্মুলা। আমি জানি না ওনারা কোন ফর্মুলা ব্যবহার করেছেন।
তবে, রিপ্রোডাকটিভ রেট (১.২৫) ধরে হিসেব করলে রাজধানীতে আক্রান্তের এই সংখ্যা আরও কম হতে পারে বলে জানান তিনি। তার মতে, করোনার মৃদু লক্ষণযুক্ত অনেক রোগী আছে রাজধানীতে। ফলে, যা শনাক্ত হয়েছে তারচেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকেই।
বাংলাদেশে ও রাজধানীতে করোনা আক্রান্তের সঠিক চিত্র পেতে পদ্ধতিমূলক গবেষণার ওপর জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বে-নজীর আহমেদ। তার মতে, এলাকাভিত্তিক জরিপ চালিয়ে করোনা শনাক্ত হওয়াদের বাইরে আরও কী পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত কিংবা উপসর্গযুক্ত সেটির ওপর গবেষণা চালাতে হবে। প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে মোট জনসংখ্যা অনুপাতে হিসেবে আসা যেতে পারে। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে এমন কোনো গবেষণা তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা নেই।
তিনি জানান, পিসিআর ল্যাব টেস্টে গড়ে ২০ শতাংশের মতো কারিগরি ত্রুটি থাকে। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬৩ হাজারের বেশি। ২০ শতাংশ ‘ফল্স নেগেটিভ’ হিসেব করলে আরও ৭০ হাজারের বেশি আক্রান্ত ধরে নেয়া যেতে পারে। আবার অনেক মানুষ উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন, অনেকে সুস্থও হয়ে যাচ্ছেন এই সংখ্যাটাও হিসেবে আসছে না। শনাক্ত হওয়াদের তুলনায় প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা ঢের বেশি বলে মনে করেন তিনি।
দ্যা ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তিনি মনে করেন এ নিয়ে সঠিকভাবে গবেষণা হওয়া উচিত। এজন্য, আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি’র মতো প্রতিষ্ঠানকে ভূমিকা রাখতে হবে।
নমুনা পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে কতটা ধারণা দিচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, মানুষ অসুস্থ না হলে সাধারণত পরীক্ষা করাতে আসে না, যারা আসেন আমরা সামর্থ অনুযায়ী চেষ্টা করি তাদের তাদের সবার টেস্ট করানোর। সীমিত সামর্থের মধ্যেও দৈনিক প্রায় ১২-১৪ হাজার পরীক্ষা করা হচ্ছে। সরকার এটিকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
শিথিলতার কারণে বাড়ছে আক্রান্তের হার:
করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষ হয়েছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতায় লকডাউন পরিস্থিতি থেকে অনেকখানি শিথিল অবস্থানে সরকার। এর ফলে করোনা সংক্রমণের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এর ছাপ পড়তে পারে সামনের দিনগুলোতে।
ডা. মুশতাক হোসেনের মতে, আমাদের মতো দেশে প্রান্তিক মানুষদের জীবিকার তাগিদে বের হতে হয়। এছাড়াও যারা উদ্যোক্তা তাদের পক্ষেও মাসের পর মাস সবকিছু বন্ধ করে রাখা কঠিন। আবার মানুষের মধ্যে গত মার্চে যে ভীতি দেখা গেছে এখন যেন সেটাও ততটা নেই। ঈদের সময় মানুষ যেভাবে বের হয়ে এসেছে ভীতি থাকলে এটা হতো না। এটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিষয়। অসতর্ক হওয়ায় মানুষ সামাজিক মেলামেশার বিধি নিষেধ অনেক সময়ই মানছে না, এ ধরনের পরিস্থিতিতে রোগীর সংখ্যা হঠাৎই বেড়ে যায়। আমরা এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরে সংক্রমণের হার লাফ দিয়ে বাড়তে দেখছি না কিন্তু যেকোনো সময় এটি হতে পারে। আমরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছি।
তার মতে, ধাপে ধাপে শিথিলতার দিকে যাওয়া উচিত ছিল সরকারের। ঈদের সময়ে যে শিথিলতা তার প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে। সব খুলে দেয়ার প্রভাব হয়তো আগামী সপ্তাহে বুঝা যাবে। রিপ্রোডাকশন রেট যেটি ১.২৫ আছে সেটি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে অর্থাৎ একজন মানুষ থেকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকছে। সংক্রমণ এখনও জ্যামিতিক হারে বাড়ছে না তবে তেমন শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমদের মতে, লকডাউনের ফলে বাংলাদেশ সংক্রমণের গতি অনেকটাই ধীর করতে পেরেছিল। এখন শিথিলতার কারণে সেটির হয়তো আরও বেড়ে যাবে। গবেষণা ও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবেলার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
Leave a reply