গেলো কয়েক বছর ধরে মিরপুর কবরস্থানে কাজ করেন মোহাম্মদ রিপন। কবর খোঁড়া, বেড়া দেয়া কিংবা পরিষ্কার সবটাই করতে হয় তাকে। এই গোড়খোদক জানালেন কিছুদিন ধরেই কাজের চাপ বেড়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১২ থেকে ১৩ টি লাশ দাফন করতে হচ্ছে তাকে।
এই চিত্র রাজধানী জুড়ে। করোনাভাইরাসের এই সময়ে আগের তুলনায় বেড়েছে মৃত্যুহার। এলাকাভেদে যা ১৫ থেকে ২৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। গেলো তিন মাসে রাজধানীর বড় তিনটি কবরস্থানের তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। করোনা ছাড়াও মহামারী আতঙ্ক, চিকিৎসার অভাবসহ নানা কারণকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
গোড়খোদক রিপনের কথার সূত্র ধরে মিরপুর কবরস্থানের রেজিষ্ট্রার খাতা ঘেঁটে দেখা গেল দেশে করোনা শনাক্তের পর থেকে এই কবরস্থানে দাফনের রেকর্ড বেড়েছে। গত বছরের নভেম্বরে যেখানে লাশ দাফন হয়েছে ১৫১ টি, এই বছরের জুন মাসে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪১ টি তে। এর মাঝে ডিসেম্বরে দাফন হয়েছে ১৪১ টি, জানুয়ারিতে ১৫২ টি, এপ্রিলে ১৫১ টি এবং মে মাসে ২০৮ টি লাশ দাফন হয়েছে মিরপুর কবরস্থানে। অর্থাৎ, নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় মে-জুন মাসে মিরপুরে দাফন হয়েছে ৩৫ শতাংশেরও বেশি লাশ।
একই চিত্র রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানেও। করোনা সন্দেহে এখন পর্যন্ত সেখানে দাফন হয়েছে সাড়ে পাঁচশো লাশ। বেড়েছে সাধারণ দাফনের সংখ্যাও। গত বছরের নভেম্বরে এই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ১১৮ টি লাশ। আর এই বছরের জুনে ২৩০ টি লাশ দাফন করা হয়েছে। অর্থাৎ, নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় মে-জুন মাসে ৫৭ শতাংশ বেশি লাশ দাফন করা হয়েছে এই কবরস্থানে। এর সাথে করোনা আক্রান্তের হিসাব যোগ করলে এই সংখ্যা আগের তুলনায় ১৯১ শতাংশ বেশি।
লাশ দাফনের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানালেন, বর্তমানে সাধারণ ও করোনা আক্রান্ত ও সন্দেহ মিলে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ টি লাশ দাফন করা হচ্ছে।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি লাশ দাফন হয় আজিমপুর কবরস্থানে। তবে করোনা আক্রান্তদের দাফন এখানে হয় না। সাধারণত প্রতিমাসে সাতশ থেকে আটশ লাশ দাফন হয় এই কবরস্থানে। এ বছর এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। আগের তুলনায় যা গড়ে ১৫ শতাংশ বেশি।
ভিন্নতা চোখে পড়েনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও। বাসাবো শ্মশানে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে সমাধির সংখ্যা। যদিও এখানে করোনা আক্রান্তদের দাহ হয়না। গত বছরের নভেম্বর মাসে যেখানে দাহ করা হয়েছে নয়টি মরদেহ; এই বছরের জুন মাসে সেখানে দাহ করা হয়েছে ৪২ টি মরদেহ। অর্থাৎ শেষ তিন মাসে গড়ে ২৮০ শতাংশেরও বেশি মরদেহ দাহ করা হয়েছে।
শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালী মাতা মন্দির ও শ্মশান কমিটির সভাপতি লায় চিত্ত রঞ্জন দাস বলেন, আমরা করোনা রোগী ছাড়া যেসব মরদেহ আসে তা দাহ করে থাকি। তবে এজন্য ‘করোনা মুক্ত’ মেডিকেল প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে। বর্তমানে ৫০ এর উপরে যাদের বয়স তাদের মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি বলে জানান তিনি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে মৃত্যুর কারণ অনেক। কারো বেলায় রোগ চিহ্নিত না হওয়ার মতো অস্পষ্টতাও রয়েছে। এজন্য চিকিৎসা না হওয়ার থেকে চিকিৎসা পাওয়ার বিলম্বতাকে দায়ী করলেন ডা. নাজমুল হোসাইন। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকল্পনার স্বার্থেই এসব মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা জরুরী।
Leave a reply