মাহফুজ মিশু:
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ঢলের তিন বছর পূর্তি আজ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে বাস্তুহারা রোহিঙ্গা ঢল নামে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। সেই সময় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশটি থেকে আরও অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই কবে, কিভাবে মিয়ানমারে ফিরবে তারা সেই আলোচনা শুরু হয়ে। দ্বিপাক্ষিক নানা আয়োজন, কয়েক দফা বৈঠক, যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি, তালিকা প্রেরণ, যাছাই-বাছাই আরও কত আনুষ্ঠানিকতা…..
কিন্তু তিন বছর পার হলেও প্রত্যাবাসন ইস্যুতে ফলাফল একেবারেই শূন্য। একজন রোহিঙ্গাও ফেরেনি নিজ দেশে। কবে ফিরবে তাও অজানা। এদিকে চলতি বছর থমকে গেছে আনুষ্ঠানিক আলোচনাও। আন্তর্জাতিক কূটনীতিও খুব একটা চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গারা এখন গলার কাঁটাই হয়ে রয়েছে। এখন বড় প্রশ্ন, রোহিঙ্গারা ফিরবে কবে?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাব, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নানামুখী স্বার্থের কারণেই আটকে গেছে রোহিঙ্গা সংকট। আর করোনা পরিস্থিতিতে থমকে গেছে সব কার্যক্রম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনও বললেন, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তারা এখন আলোচানা করতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘তাদের সাথে আমাদের বেশ কয়েকটি আলোচনা হবার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সংকট এবং তাদের দেশের নির্বাচনের অজুহাত দিয়ে তারা সব আলোচনা পিছিয়ে দিচ্ছে।’
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে গত বছরের ২২ আগস্ট সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু তারা যেতে না চাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরও আরেক দফা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ-সমাবেশের কারণে সে দফায়ও প্রত্যাবাসন পক্রিয়া ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর থেকে গত এক বছরে নতুন কোনো প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ আর নেয়া হয়নি। গত বছরের ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া। সে মামলা বর্তমানে বিচারাধীন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের কারণে শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে গত বছর বাংলাদেশ-চীন শীর্ষ বৈঠকে সহযোগিতার আশ্বাস এলেও তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। গত তিন বছরে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনাও হয়েছে। গঠিত হয়েছে ত্রিপক্ষীয় কমিটি। কিন্তু ফেরত পাঠানো যায়নি একজনকেও। প্রশ্ন উঠেছে, রোহিঙ্গা কূটনীতিতে কি ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ?
তবে কূটনীতিতে সরকার ব্যর্থ- এমনটা মানতে নারাজ পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। বললেন, ‘একহাতে তো তালি বাজে না; আমরা চাইলেই সব হয় না। মিয়ানমারকে রাজি হতে হবে। তারা সহজে রাজি হতে চায় না। কারণ তারও বন্ধু দেশ আছে।’ তবে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।
সবশেষ ছয় লাখ রোহিঙ্গার তথ্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। তালিকা থেকে মাত্র ত্রিশ হাজার জনকে নিজেদের নাগরিক বলে চিহ্নিত করেছে মিয়ানমার। এজন্য মিয়ানমারের আন্তরিকতার অভাবকেই দায়ী করলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। বলেন, ‘তাদের যাচাই পক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতি। মনে হয় না তাদের আন্তরিকতা আছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের পক্ষে জনমত গড়তে মিয়ানমারের সুশীল সমাজের সাথে বাড়াতে হবে যোগাযোগ। যে কোন পরিস্থিতিতে দেশটির সাথে আলোচনার পাশাপাশি চীন ও ভারতের সাথে যে সু-সম্পর্ক আছে তা কাজে লাগাতে হবে। এই অবস্থা স্থবির থাকলে মানবপাচার, মাদক চোরাচালনসহ অন্যান্য সংকট বাড়বে। একইসাথে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান বিচার কাজ ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টাও চালাতে হবে বাংলাদেশকে।
Leave a reply