পটুয়াখালী প্রতিনিধি:
হত্যা মামলার বাদি ও সাক্ষীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে এক নারী মামলা করার দেড় বছর পর আসামিদের নোটিশ দিয়েছেন তদন্তের দায়িত্বে থাকা বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার।
অথচ ওই তদন্তকারী নিজেই একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি আর সেই হত্যা মামলার বাদিকে করা হয়েছে ওই ধর্ষণ মামলার আসামি। পটুয়াখালীর বাউফলে এমন ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, বাউফল উপজেলার চম্পা বেগম (২৫) নামে এক নারী ধর্ষণের অভিযোগ এনে মো. জাকির হোসেনকে (৩০) প্রধান করে মো. শফিকুল ইসলাম (৩৫) ও মো. জালাল ফকির (৩৫) এর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল পটুয়াখালী বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর ওইদিনই বিজ্ঞ আদালত তৎকালীন বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদারকে মামলাটি তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদেশ দেন। কিন্তু মোতালেব হাওলাদার কালক্ষেপণ করে দীর্ঘ দেড় বছর পর ওই ধর্ষণ মামলার তদন্তের জন্য মামলার বাদি, বিবাদি এবং স্বাক্ষীগণকে নোটিশ প্রদান করেন। নোটিশে গত ৮ই অক্টোবর তারিখের স্বাক্ষর রয়েছে।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি মো. জাকির হোসেন হলেন ২০১৩ সালের ৫ আগষ্ট মো. মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা মামলার বাদি। এছাড়া ধর্ষণ মামলার বাকি দু’জন আসামি হলেন মনির হোসেন হত্যা মামলার সাক্ষী। আর যিনি ওই ধর্ষণ মামলা তদন্ত করার দায়িত্ব পেয়েছেন (মোতালেব) তিনি হলেন মনির হোসেন হত্যা মামলার প্রধান আসামি এবং তিনি তখন (২০০৩ সালের ৫আগষ্ট) বাউফল উপজেলার বগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
অর্থাৎ বগা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার একদিকে মনির হোসেন হত্যা মামলার প্রধান আসামি অপরদিকে ওই ধর্ষণ মামলার তদন্তকারী; যে ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে মনির হোসেন হত্যা মামলার বাদিকে। বর্তমানে মনির হোসেন হত্যা মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে। এছাড়া ধর্ষণ মামলার বাদি, আসামি ও তদন্তকারী ব্যক্তি সবাই বগা ইউনিয়নের বাসিন্দা।
এদিকে ধর্ষণ মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল পটুয়াখালী বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলাটি করেন চম্পা বেগম নামের এক নারী। ঘটনার দিন ও সময় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটা। আরও উল্লেখ করেছেন, ওই দিন রাতেই ওই নারী আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন। বাদির আইনজীবীর আবেদন অনুযায়ী আদালত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদারকে। ব্যক্তিজীবনে মামলার বাদি চম্পা বেগম বিবাহিত।
দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর সম্প্রতি স্থানীয় চৌকিদার ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি জাকির হোসেনের বাড়িতে নোটিশ নিয়ে যান। কিন্তু জাকির হোসেন বাড়িতে না থাকায় ওই নোটিশ কেউ রাখেনি। জাকির হোসেন পরে পরে আদালতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার (জাকির) বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা হয়েছে।
ধর্ষণ মামলায় পাঁচ ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে এক নম্বর সাক্ষী মো. সত্তার ঘরামি বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এই প্রথম আপনার (সাংবাদিক) মাধ্যমে শুনলাম।’
দুই নম্বর সাক্ষী মো. খালেক মোল্লা ও পাঁচ নম্বর সাক্ষী মো. হেমায়েদ বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সবাই জানতো। এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না।’
এমনকি মামলার বাদি চম্পা বেগমের স্বামী মো. বাদল হাওলাদার বলেন, ‘আমার স্ত্রী ধর্ষিত হলে প্রথমে আমার জানার কথা। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার দুপুরে বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল রাতে চম্পা বেগম নামে কোনো নারী ভর্তি হননি কিংবা চিকিৎসাও নেয়নি বলে জানা যায়। ওইদিন রুমা (২১) ও আসমা (৩০) নামে দুই নারী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে রুমার বাড়ি কালাইয়া ইউনিয়নের কর্পূরকাঠী গ্রামে এবং আসমার বাড়ি কাছিপাড়া গ্রামে।
যোগাযোগ করা হলে ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী মো. জাকির হোসেন জানান, হত্যা মামলার বাদি হওয়ায় ২০১৩ সালের পর বাড়ি যেতে পারছি না। আসামিদের ভয়ে পুলিশ পাহারায় বাউফলের বগা কেন্দ্রে গিয়ে স্নাতক (বিএ) পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে। এছাড়াও দুইবার জরুরী প্রয়োজনে বাউফলে গিয়েছি, দুইবারেই আমার ওপর হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশ উদ্ধার করেছে। সর্বশেষ হামলায় আমার হাত ও পা ভেঙে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এখনও আমার পায়ের মধ্যে রড রয়েছে। আবার অস্ত্রোপচার করে রড বের করতে হবে। এ কারণে ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হয়েছে আমাকে।
জাকির হোসেন আরও বলেন, ‘হত্যা মামলাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য মামলার প্রধান আসামি প্রভাব বিস্তার করে এই ধর্ষণ মামলা করেছে। যার প্রমাণ হল ধর্ষণ সম্পর্কে মামলার সাক্ষী ও চম্পা বেগমের স্বামী কিছুই জানেন না বলে আমাকেও জানিয়েছেন।’
জানতে চাইলে বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার জানান, নানা কারণে নোটিশ দিতে দেরি হয়েছে। তবে নোটিশের জবাবে কেউ আসেনি। বাদি, বিবাদি এমনকি স্বাক্ষীরাও না আসায় ‘ঘটনা মিথ্যা’ বলে আমি আদালতে প্রতিবেদন
দাখিল করিছি।
Leave a reply