ভ্যাকসিন নিবো কি নিবো না এই বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন অনেকই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে ভ্যাকসিন আসলে আপনি কি আগে নিবেন? আমি তখন বলেছি হ্যাঁ আমি নিবো।
কারণ-
১) আমি বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করি। কারণ প্রামাণিক কোনো দলিল ছাড়া বিজ্ঞান কখনোই কোন দাবি করে বসে না। যেমন, আপাত দৃষ্টিতে সূর্যকে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে দেখলে আসলে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে, এটা বিজ্ঞানই প্রমাণ করেছে। তাই বিজ্ঞান তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে কথা বলে। ধারণাগত কোনো বিষয়ের কথা বলে না। আর এলোপ্যাথি ওষুধের ক্ষেত্রে তাতো অনেক ধাপ এগিয়ে। এক কথায় অকল্পনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরই তা মানব শরীরে প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হয়।
২) যেকোনো ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরি-প্রাণী এবং মানব শরীরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর কার্যকর এবং নিরাপদ প্রমাণিত হলেই সবার জন্য উন্মুক্ত ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হয়। নদীর ময়লা ও দূষিত পানিকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশুদ্ধ করে যেমনি নিরাপদ পানীয়যোগ্য করা হয়, ঠিক তেমনি বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবগুলো ধাপে সফল হলেই কেবল ওষুধকে মানুষের শরীরে শতভাগ নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়।
৩) করোনা ভ্যাকসিন সকলের জন্য ব্যবহারের অনুমোদন দেবার আগে ৩০ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবকদের (মানুষ) শরীরে প্রয়োগের মাধ্যমে গবেষণা চালানো হয়। গবেষণাকালে কোনো তীব্র পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, কিংবা মৃত্যুর কোনো প্রমাণ মিলেনি।
৪) শিশুদের ভ্যাকসিন দেয়ার সময় যেমনি কিছু মৃদু উপসর্গ দেখা যায়, করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এ পর্যন্ত তার ব্যতিক্রম কিছু দেখা যায়নি।
৫) ভ্যাকসিনের গবেষণাকালীন ৩০-৪০ হাজার মানুষ এবং পরবর্তীতে ভারতে ২০ লক্ষ ও ইংল্যান্ডে ৭০ লক্ষ মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। কারোর শরীরেই মৃদু প্রতিক্রিয়া ব্যতিরেকে মারাত্মক কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যাইনি। যা শোনা যাচ্ছে তা আসলে কেবলই গুজব। কারণ ভারতে যে একজন মারা গেছে বলে প্রচার করা হয়েছিল, তার ময়নাতদন্ত (পোস্টমর্টেম) অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে মৃত্যুর সাথে আসলে ভ্যাকসিনের কোনো যোগসূত্রতা নেই।
৬) নরওয়েতে ভ্যাকসিন দেয়ার পর যে ২৩ জনের মৃত্যুর গুজব আছে তা প্রথমত একদিনের নয়, ৬ দিনের। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেকেরই বয়স ৭৫ এর ঊর্ধ্বে এবং বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। আর নরয়েতে প্রতিদিন বৃদ্ধাশ্রমে গড়ে ৪৫ জন মারা যায়, এটা সবারই জানা। তাই এ মৃত্যু সংখ্যাটা স্বাভাবিক হারের চেয়েও কম। তাছাড়া তাদের মৃত্যুর কারণে ভ্যাকসিনের কোনো যোগসূত্রতাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই ভ্যাকসিন আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষের শরীরে প্রয়াগ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সেখানে কোনো রকম তীব্র পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
৭) ভ্যাকসিন দেয়ার পর যেসমস্ত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়, তা হলো-
ইনজেকশন স্থানে সামান্য ব্যথা ও ফুলে যাওয়া, চামড়ার প্রদাহ (rash), চুলকানি, ইনজেকশন স্থান শক্ত হয়ে যাওয়া, সামান্য জ্বর, স্বল্পস্থায়ী অবসাদ-ক্লান্তি, বমি ভাব, গিরা ব্যথা ও শরীর ব্যথা। এতে বোঝা যাচ্ছে করোনা ভ্যাকসিনটি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দ্রুত উদ্দীপিত করতে পারছে। যা মূলত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এটা সবার ক্ষেত্রে হবে সেটাও কিন্তু সঠিক নয়। অর্থাৎ এরকম উপসর্গ না হলেই যে ভ্যাকসিন কার্যকরী নয় তা বলা যাবে না। কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে এর কার্যকারিতা ৭০-৮০% ক্ষেত্রে প্রমাণিত।
৮) এই ভ্যাকসিনে যে বাহক এডেনো ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে তা মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। অর্থাৎ বাহক ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করে ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো করোনাভাইরাসকে ব্যবহার করা হয়নি। কেবল এর একটি প্রোটিনকে ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা শুধু শরীরে প্রবেশের পর করোনা ভাইরাসের বিপরীতে antibody তৈরি করাতে পারবে।
৯) এই ভ্যাকসিনে সে দ্রাবক ও দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে, যা আমাদের শিশুকালে দেয়া ভ্যাকসিনগুলোতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই শিশুকালে দেয়া ভ্যাকসিনে যেমন শিশুর কোনো সমস্যা করেনি তেমনি এই ভ্যাকসিনটিও নিশ্চিত কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।
১০) আমার অ্যাজমা, কোল্ড-ডাস্ট ও ফুড এলার্জি রয়েছে তারপরও এ ভ্যাকসিন আমি নিবো। কারণ আমার এ ধরনের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও পূর্বে কোনো ইনজেকশন বা ভ্যাকসিনে আমার মারাত্মক কোনো অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়নি।
১১) আমার দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগ আছে তারপরও আমি ভ্যাকসিন নিবো কারণ ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চেয়েও আমার রোগের কারণে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। তাই চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে আমি ভ্যাকসিন গ্রহণ করবো।
১২)আমি ব্যক্তিগতভাবে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ভ্যাকসিন নিলে আমি সুরক্ষিত থাকবো এবং আমার দ্বারা আমার পরিবার, কর্মক্ষেত্রের অন্যান্য সদস্যের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে।
১৩) ভ্যাকসিন নেয়া থাকলে পরবর্তীতে করোনায় আক্রান্ত হলেও মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়া হতে রক্ষা করবে। যেমনি যক্ষ্মা রোগ হলেও এখন আর যক্ষ্মা রোগে কেউই মারা যায় না। কারণ আমরা সবাই মোটামুটি যক্ষ্মার টিকা নিয়েছি শিশুকালে।
১৪) ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি ভ্যাকসিন দেয়ার ৩য় সপ্তাহের মধ্যে আমেরিকার করোনা শনাক্তের হার ১৬% কমে গেছে।
১৫) ইউরোপ আমেরিকার মতো করোনার ২য় ঢেউ আসলে আবার লক ডাউনে পড়তে হবে যা আমাদের উদীয়মান অর্থনীতিকে আবারও থমকে দিবে।
১৬) কেবল একজন থেকেই আক্রান্ত হতে পারে ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যেকে! তখন ১.৪৯% মৃত্যুহার হিসেবে প্রায় ২৭ লক্ষ লোক মারা যাবে। তারমানে এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে কান্না থাকবে না।
১৭) ভ্যাকসিন দেয়ার সময় হাসপাতালে বসে দেয়া হবে এবং সেখানে ডাক্তার ও সম্ভাব্য সকল প্রকার সমস্যার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে।
১৮) আমি দেশকে ভালবাসি এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করি।
১৯) আমি প্রকৃত ফ্রন্ট লাইনার এবং একটি জেলার করোনা ইউনিটের প্রধান। আমাকে দেখে অনেকে সাহস পাবে তাই নিবো।
পক্ষান্তরে কেনো আমি ভ্যাকসিন নেবো না-
১) আমি গর্ভবতী ও বাচ্চাকে দুধ খাওয়াই।
২) আমার বয়স ১৮ বছরের নিচে।
৩) ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেয়ার পর তীব্র অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হয়েছে, তাই ২ ডোজ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪) পূর্ববর্তীতে বিভিন্ন ইনজেকশন ও ভ্যাকসিন দেয়ার পর তীব্র অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন (এনফিলাক্সিক্স) হয়েছে।
৫)আমি করোনা আক্রান্ত হয়েছি ২৮ দিন পার হয়নি এখনও। অপ্রতুলতার কারণে ৯০ দিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন না নিয়ে থাকতে পারবো নির্ভয়ে।
৬) আমি এই মুহূর্তে একিউট কোনো রোগে ভুগছি, তবে ক্রনিক স্ট্যাবল রোগে দিতে পারবো।
৫) চিকিৎসক আমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে যখন।
৬) অগ্রাধিকার মোতাবেক সিরিয়াল না আসা পর্যন্ত।
ডা. মো. কামরুল আজাদ
মেডিসিন, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
ইউনিট প্রধান
করোনা আইসোলেশন ইউনিট
বরগুনা জেলা সদর হাসপাতাল, বরগুনা।
Leave a reply