সবুজ পাহাড় আবারও রক্তে লাল, কী হচ্ছে সেখানে? (ভিডিও)

|

ক্রমশ ঘোলাটে হচ্ছে পাহাড়ের পরিস্থিতি

সবুজ পাহাড় আবারও রক্তে লাল, অশান্ত পাহাড়ী জনপদ। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাতে তুলেছেন অস্ত্র। আত্মগোপনে থেকে চালাচ্ছেন শান্তিচুক্তি বিরোধী তৎপরতা। গহীন পাহাড়ে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে আঞ্চলিক নেতারা জোট বাঁধছেন নিজের দেশের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে শঙ্কিত ও আতঙ্কিত পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ। পাহাড়ে আসলে হচ্ছেটা কী, কারাই-বা দেশের বিরুদ্ধে করছে ষড়যন্ত্র; এসব প্রশ্ন হচ্ছে জোরালো।

বান্দরবানের রুমা উপজেলার পাহাড়ি গ্রাম বথিপাড়ায় বসবাস মাত্র সাতটি পরিবারের। এখানেই কদিন ধরে অবস্থান করছিল সশস্ত্র আট সন্ত্রাসীর একটি গ্রুপ। খবর পেয়ে ২ ফেব্রুয়ারি রাইংক্ষং থেকে অভিযানে নামে সেনাবাহিনীর একটি দল। পাঁচ ঘণ্টার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অভিযান চালানো হয় সন্ত্রাসীদের আস্তানায়। অভিযানে নিহত হওয়া তিন সশস্ত্র যুবকের প্রত্যেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সদস্য। সন্ত্রাসীদের পাল্টা গুলিতে নিহত হন সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হাবিবুর রহমান। আহত হন একজন সৈনিক।

বিস্তারিত দেখুন এখানে: পাহাড়ে আবারো অশান্তির আভাস; জোট নিজের দেশের বিরুদ্ধেই!

আলোচিত এ অভিযান প্রসঙ্গে বান্দরবানের রুমা জোনের জোন কমান্ডার লে. কর্নেল হাছান শাহরিয়ার ইকবাল জানান, সেখানে অবস্থানকারীরা জেএসএস এর সন্ত্রাসী। ওই এলাকায় যাওয়ার সাথে সাথে সন্ত্রাসীরা তার ওপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। উনি থেমে না গিয়ে পাল্টা গুলি বর্ষণ করেন। এবং এই গোলাগুলির সময় সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্য ল্যান্স করপোরাল মামুন বলেন, আমাদের জীবন এরকমই। আমরা যোদ্ধা, আমরা সৈনিক। এটা জেনেই আমরা শপথ নিয়েছি, সিনিয়র যেখানে যাওয়ার আদেশ করবেন সেখানেই যাবো। নির্দেশ পেলে আমরা যেকোনো সময় জীবন দিতে প্রস্তুত।

কিন্তু দেশের মাটিতে কেনো জীবন দিতে হচ্ছে সেনাবাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে? কেনই বা বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে সবুজ পাহাড়? এর পেছনে কারা? জানা গেছে, একটা সময় পাহাড়ের এই সন্ত্রাসীরা হালকা অস্ত্রে সজ্জিত থাকতো। অল্পকিছু একে-৪৭, জি-৩’র মতো আর্মস দেখা যেত তাদের হাতে। কিন্তু সম্প্রতি রকেট লঞ্চার, স্নাইপার রাইফেল, গ্রেনেডসহ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সশস্ত্র গ্রুপগুলো। তারা জুমল্যান্ড লিবারেশন আর্মি আবার কখনও জুমল্যান্ড আর্মি নামে নিজেদের পরিচয় দেয়।

জেএসএস-এর প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন নেই বললেই চলে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, হাই-কমান্ডের নির্দেশে অনেক শীর্ষ নেতাই এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। এ প্রসঙ্গে, জেএসএস (সন্তু) এর আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য, সাধুরাম ত্রিপুরা (মিল্টন) যমুনা নিউজকে ফোনে বলেন, কিছু কর্মী তাদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের সিদ্ধান্তের বাইরে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। তারা আমাদের দলেরই সদস্য কিন্তু বললে শুনবে না, তারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে এখন।

সম্প্রতি রুমার চেমা খালে সামরিক পোশাকে দেখা গেছে, বান্দরবান জেলা জেএসএস-এর সহ-সভাপতি, রুমা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অং থোয়াই চিং মারমাকে। জেলা জেএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক কেবা মং মারমাও চলে গেছেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। তিনি রোয়াংছড়ির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।

সম্প্রতি অভিযানে যে তিনজন নিহত হয়েছে তাদের ব্যাপারে সাধুরাম ত্রিপুরা (মিল্টন) বলেন, দেখুন তারা আমাদের সমর্থিত, তবে নিয়ন্ত্রিত নয়। সেনা পোশাকও পরতে হয় তাদেরকে।

জেএসএসের বাইরে পাহাড়ে তৎপরতা বেড়েছে ইউপিডিএফসহ কয়েকটি সশস্ত্র দলের। তাদের উপস্থিতি ও চলাফেরায় ফের সন্ত্রস্ত অবস্থায় আছে বাংলাদেশের পার্বত্য জনপদ। একেবারে দুর্গম পাহাড়েও তাই লেগেছে চাপা উত্তেজনার আঁচ। তিন দেশের সীমান্তের সবচেয়ে কাছের পাড়া ধোপানীছড়া। ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণে এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সশস্ত্র গোষ্ঠীর আনাগোনা বেশি বেড়েছে এর উত্তরের শিপ্রু পাড়া থেকে দক্ষিণে জারুছড়ি পাড়া পর্যন্ত। জানা যায়, নতুন করে এলাকাগুলো দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে তারা।

ধোপানীছড়ার স্থানীয় কারবারী জাতিরয় ত্রিপুরা বলেন, সরকারের সাথে কথা বলে এমন ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করতে হবে, যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। এটা যে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ তা যেন বলতে পারি। আমরা অশান্তি চাই না,শান্তিতে থাকতে চাই।

দুর্গম এ সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ চলছে এবং বেড়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিওপি। সতর্ক নজরদারি আছে সেনাবাহিনীরও। তবে নানা প্রতিকূলতায় ভরা বিশাল এ জনপদকে নিশ্ছিদ্র রাখা সহজ কাজ নয়। জনসংহতি সমিতি (সন্তু), ইউপিডিএফ-প্রসিত’সহ কয়েকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সশস্ত্র অবস্থানের খবর পাওয়া যায় তিন পার্বত্য জেলার আরও অনেক গ্রামে।

বান্দরবানের রুমা জোনের জোন কমান্ডার লে. কর্নেল হাছান শাহরিয়ার ইকবাল বলেন, শান্তিচুক্তির পরে অস্ত্র যেভাবে জমা হওয়ার কথা ছিল, অস্ত্রগুলো সেভাবে জমা হয়নি। সন্ত্রাসীদের কাছে এখনও সেসব অস্ত্র রয়ে গিয়েছে।

অস্ত্রের ঝনঝনানিতে নতুন অস্থিরতার শঙ্কায় বথি পাড়া, রুমার যে গ্রামে সবশেষ রক্ত ঝড়েছে। চুক্তি ভেঙে আবারও আগের পথে যাচ্ছে কিনা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো, সেই শঙ্কার অস্তিত্বই এখানকার মানুষের ভয়ের কারণ। বথিপাড়ার এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমরা তো শান্তিতেই থাকতে চাই। পরিবার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ভাল থাকতে চাই। এ রকম অশান্তি কে চায় বলেন? আপনারা বা আমরা কেউই এমন অশান্তি চাই না।

জানা গেছে, শান্তিচুক্তির সময় আত্মসমর্পণ করা বেশ কয়েকজন আবারও অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে। গোয়েন্দাসহ বিভিন্ন সূত্রের আভাস মতে, দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বড় কোনো ষড়যন্ত্রের অপচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। বান্দরবান ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা বললেন, বান্দরবানে জেএসএসের মূল ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের যে নেতৃবৃন্দ আছে এরা শক্তভাবে অবস্থান নিচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, যেখানে এভাবে হত্যা করা হয় সেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন। তারমানে তারা এদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেনা। সন্ত লারমা তো কোনোদিন শহিদ মিনারে যাননি। শান্তিচুক্তির ২৪ বছর হয়ে গেছে, এরমধ্যে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা মাতৃভাষা দিবসে সে কোনোদিনও শহিদ মিনারে যায়নি, কেউ দেখেনি যেতে।

শুধু সশস্ত্র নেতারা নন, সম্প্রতি গোপন অবস্থানে চলে গেছেন তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরাও। এই ঘটনাকে বড় দুর্যোগের পূর্বাভাস মনে করেন গোয়েন্দারা।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply