‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’

|

শেন কিথ ওয়ার্ন (১৯৬৯-২০২২) ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেটের রকস্টার শেন ওয়ার্নের অকাল মহাপ্রয়াণে বিস্মিত ও হতবাক ক্রীড়াঙ্গন। এবার যেন শুধু আর ব্যাটারদের নয়, আইকনিক ক্যারিয়ারের হলমার্ক দুর্দান্ত ফ্লিপারে পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে বোকা বানিয়ে দিয়েছেন এই স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্ন। অজি অধিনায়ক প্যাট কামিন্স তাই বলেছেন যথার্থ, সর্বকালের সেরা ছিলেন ওয়ার্নি; এক শতকে একবার আসার মতো এক ক্রিকেট।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের প্রথমদিনের খেলা শেষে হোটেলে ফিরে অস্ট্রেলিয়া দল জানতে পারে ওয়ার্নের আকস্মিক মৃত্যুর কথা। প্যাট কামিন্স বলেন, তার রেকর্ডই তার হয়ে কথা বলে। তাকে দেখেই বড় হয়েছি আমরা, তাকে আইডল মেনেই ক্রিকেট খেলার শুরু। আমাদের সবার ঘরের দেয়ালেই শোভা পেত ওয়ার্নের পোস্টার। আমাদের সংগ্রহে থাকতো তার ইয়ার রিং। বিনোদনদায়ী ওয়ার্নের ক্যারিশমাও ছিল অনন্য। আর অসাধারণ ক্রিকেট মস্তিষ্কের ধারে অস্ট্রেলিয়াকে ম্যাচের পর ম্যাচ জেতানো পারফরমেন্স আর লেগ স্পিন; সে-ই ছিল আমাদের হিরো। ক্রিকেটে ওয়ার্নির আগমনের আগে ও প্রস্থানের পর খেলাটি আর একইরকম থাকেনি। শান্তিতে থাকুন, কিং।

ছবি: সংগৃহীত

এইসব আবেগমথিত ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুরো বিশ্বজুড়ে। শেন ওয়ার্ন চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন ক্রিকেট বিশ্বে, আর এর সূচনাও হয়েছিল জগত কাঁপিয়ে! ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সূচনা পর্বের নিজের আগমনী বার্তা জানান দিয়েছিলে তিনি পিচে আগুন জ্বালিয়ে! ওল্ড ট্রাফোর্ডে ১৯৯২ সালে মাইক গ্যাটিংকে আউট করেছিলেন শতকের শ্রেষ্ঠ ডেলিভারিতে। সেই শুরু ক্রিকেট বিশ্বকে হতবাক করে দেয়ার। যখন শেষ করেন সোনায় মোড়ানো ক্যারিয়ার, ২০০৭ সালের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশের সাথে ১৪৫ টেস্টে ৭০৮ উইকেট রয়েছে তার নামের পাশে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালের ম্যাচ সেরা নামটাও ছিল শেন কিথ ওয়ার্নের। ক্রিকেটীয় উপাখ্যানে জায়গা করে নেয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, প্রোটিয়ারাই যাচ্ছে ফাইনালের মঞ্চে। ২০১৩ রানের টার্গেটে বিনা উইকেটে ৪৮ রান তুলে ফেলেছিলেন গ্যারি কার্স্টেন ও হার্শেল গিবস। তখনই মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে জাদুকরের, বল হাতে তুলে নেন ওয়ার্ন। বিশাল টার্নে কার্স্টেনকে পরাস্ত করে ম্যাচে ফেরান অজিদের। তারপরের ওভারে হার্শেল গিবসকে যে বলে বোল্ড করেন তিনি, সেটা তর্কসাপেক্ষে মাইক গ্যাটিংকে আউট করা বল অব সেঞ্চুরির সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এরপর হ্যান্সি ক্রনিয়ে এবং জ্যাক ক্যালিসকেও আউট করে তিনি ভেঙে দেন প্রোটিয়া ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। ম্যাচটি যদি ল্যান্স ক্লুজনারের ঝড় ও অ্যালান ডোনাল্ডের পাগলাটে দৌড়ের জন্য বেশি খ্যাত না হতো, তবে ফাইনালে একার হাতে পাকিস্তানকে ধসিয়ে দেয়ার সাথেই উচ্চারিত হতো সেমিফাইনালে ওয়ার্নের বীরত্ব।

ছবি: সংগৃহীত

শেন ওয়ার্নের অকাল বিদায় মানতে পারেননি ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। টুইট করে তিনি বলেছেন, আমি হতবাক ও বিস্মিত! তোমাকে মিস করবো ওয়ার্নি। মাঠ ও মাঠের বাইরে তোমার সাথে কাটানো কোনো মুহূর্তই সাদামাটা ছিল না। মাঠে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মাঠের বাইরের বন্ধুত্বকে খুঁজে যাবো আমি।

পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বোলিং ইউনিটে শেন ওয়ার্নের প্রধান স্ট্রাইকিং সঙ্গী গ্লেন ম্যাকগ্রা টুইটে লিখেছেন, সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছি। জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিলেন ওয়ার্ন। আমি ভাবতাম, এমন কিছুই তার সাথে ঘটতে পারে না। জীবনটাকে আমরা কেবল যাপন করে গেছি, আর সে করেছে উদযাপন। ওয়ার্নির সাথে থাকলে আনন্দহীন কোনো মুহূর্তের কথা মনে করতে পারি না। দারুণ এক বন্ধু ছিল সে, ছিল অসাধারণ এক বাবা। ভালো থেকো। তোমার মতো কেউই আসবে না।

ছবি: সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী একাদশের আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ অ্যাডাম গিলক্রিস্টও জানিয়েছেন ওয়ার্ন নিয়ে তার ভাবনার কথা। টুইটে গিলি লিখেছেন, শূন্য লাগছে। আমার ক্যারিয়ারের হাইলাইটস হচ্ছে ওয়ার্নের বলে কিপিং করা। বিশ্বসেরা বোলারকে উপভোগ করার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গাতেই ছিলাম। ভালো থেকো।

স্টিভ ওয়াহর ভাষায় শেন ওয়ার্ন ছিলেন মাঠ ও মাঠের বাইরে সার্বক্ষণিক এক বিনোদনের উৎস। ব্রেট লীর কাছে ‘ক্রিকেটের রকস্টার’ শেন ওয়ার্ন ছিলেন সর্বকালের সেরা বোলার। আর ইয়ান বোথাম হারিয়েছেন অসাধারণ এক বন্ধুকে। রমিজ রাজার ভাষায়, অনেকখানি ক্রিকেটই যেন চলে গেল আজ। তেমনটি অবশ্য হওয়ারই কথা। রিচি বেনো কখনও ওয়ার্নকে নিয়ে বলতে গেলে ‘সেরা স্পিনার’ এ আটকে থাকতেন না; তার কাছে সর্বকালের সেরা বোলারই ছিলেন ওয়ার্ন।

অবশ্য পরিসংখ্যানের কী সাধ্য ওয়ার্নকে প্রকাশ করে! ওয়ার্নের সাক্ষাৎ পাওয়া এক সাংবাদিকের বলেছিলেন, জীবনে ২০ হাজারের বেশি সাক্ষাৎকার দেয়া ওয়ার্নকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি একদম চোখের দিকে তাকাতেন। গভীর মনোযোগে যেন প্রকাশ করতেন, সেই মুহূর্তে সেই প্রশ্নকর্তা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ!

ছবি: সংগৃহীত

আরেক শেন ওয়ার্ন অনুরাগীর টুইটে ছিল, রাজস্তান রয়ালসের অধিনায়ক হিসেবে প্রথম আইপিএল জিতেছিলেন ওয়ার্ন। ফাইনালের দিনই আমার সন্তানের জন্ম হয়। রাতে ঘরে শিশুটাকে নিয়ে উল্লাস করছিলাম আমি। বাচ্চাটার কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। তাই তাকে ডাকলাম ‘শেন’ বলে।

এভাবেই পরিচিত মানুষ থেকে শুরু করে কখনোই দেখা না হওয়া শেন ওয়ার্নের সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্বজোড়া অগণিত মানুষের অসংখ্য গল্প। এমন সর্বজয়ী চরিত্র আর কখনোই আসবে না। জীবনানন্দের ভাষায়, এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর…

এম ই/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply