জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার মতো জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ?

|

ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ:

কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, জলবায়ু নাকি জীববৈচিত্র্য?
কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত হওয়া দি পোস্ট-২০২০ গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের ৪র্থ ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিংয়ে এই আলোচনাটি আবার ঘুরে ফিরে এসেছে যে পৃথিবীর দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের মত জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে কিনা।

ফ্রান্সিস, এখানকার একজন সিবিডি কো-চেয়ার বলেছেন, দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্য এই দুটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করতে দেখে তিনি দুঃখবোধ করেন, তাদের আলোচনা দেখে মনে হয় যেন এ দুটো বিষয়ের উভয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যকে সরাসরি প্রভাবিত করছে, কিন্তু তারপরও জলবায়ু পরিবর্তনকে এত বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় যখন জীববৈচিত্র্যকে দেয়া হয় না।

ব্রাইয়ান ও’ ডোনেল, যিনি ক্যাম্পেইন ফর নেচারের পরিচালক। সিবিডি সাংবাদিক সম্মেলনে এসে ডোনেল জানান, ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং বায়োডাইভারসিটির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট যেকোনো বড় জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। কার্বন নির্গমণ থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। এই বনের আশেপাশে যারা বসবাস করে তাদের জন্যও এই বন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেবল বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর অনেক দেশ বায়োডাইভারসিটি থেকে ক্লাইমেট চেঞ্জকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

বায়ো ডায়ভারসিটি নিয়ে বাংলাদেশে পদক্ষেপ কি?
বায়োডাইভারসিটি নিয়ে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত পদক্ষেপ সুখকর নয়। বাংলাদেশের সরকার, এনজিও তথা পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বিষয়ে যতটা উদ্বেগ দেখান বায়োডাইভারসিটি রক্ষার নিয়ে ততটা মনযোগী নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি, যেই আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন দেশে দুর্নীতি বন্ধ ও সুশাসন নিশ্চিতে কাজ করে, সেই টিআইবি ২০২০ সালে তাদের বিবৃতি জানায়, বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় বিদ্যমান আইনি কাঠামোর যথাযথ প্রয়োগে ঘাটতির কারণে জীববৈচিত্র্য যেমন লোপ পাচ্ছে তেমনি পরিবেশ দূষণ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য ব্যাপক ঝুঁকির কবলে পড়েছে, বন ও জলাশয় দখল বেড়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ক্রামাগত চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হচ্ছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় ‘সুশাসনের ঘাটতি, বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের প্রভাব-নির্ভর সিদ্ধান্ত, দুর্বল তদারকি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়ম এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাকে’ ঝুঁকির কারণ বলে মনে করে টিআইবির পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে টিআইবি বলছে, ১৯৮৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে মোট ৪ লাখ ১৬ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে যার মধ্যে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩১ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি জবরদখলের শিকার হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি ধ্বংসের কারণে ইতোমধ্যে বন্যপ্রাণীর ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও প্রায় ৩০টি প্রজাতির অস্তিত্ব ‘মারাত্মক সঙ্কটে’ রয়েছে যা বনকেন্দ্রিক জীবনচক্র ও বাস্তুসংস্থানের জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে মনে করছে টিআইবি।

টিআইবির পরিচালক বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কাছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক রক্ষাকবচকে ‘স্থায়ীভাবে ঝুঁকির মধ্যে’ ফেলা হয়েছে। অথচ সুন্দরবন যেমন সমৃদ্ধ জীবজগতকে ধারণ করে প্রাণ ও প্রকৃতির রসদ যোগাচ্ছে, তেমনি সাম্প্রতিককালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ফণীসহ সর্বশেষ আম্পানের তাণ্ডব হতে উপকূলের অজস্র মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সুরক্ষা প্রদান করেছে। আমাদের একটাই সুন্দরবন, এই সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।

সুন্দরবনসহ অন্যান্য পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও নির্মাণাধীন সকল শিল্প ও কারখানা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। এই বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বাংলাদেশ যতটা সরব জীববৈচিত্র রক্ষা ইস্যুতে ততটাই দুর্বল।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?
বায়োডাইভারসিটি রক্ষায় যে টার্গেটগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে টার্গেট-৪ এবং টার্গেট-৭ বাংলাদেশের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ। টার্গেট-৪ এ বলা হয়েছে প্রাণীদের রক্ষা করার কথা আর টার্গেট-৭ এর পরিবেশের ওপর দূষণ কমানোর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এই দুটো সমস্যারই ভুক্তভোগী। বাংলাদেশ এই টার্গেটগুলো কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে?

দি পোস্ট-২০২০ গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্কের ৪র্থ ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার, যিনি বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক। পরিবেশ অধিদফতর হলো পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের একটি অন্যতম সংস্থা।

তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এখানে নাইরোবিতে আসার আগে ৪র্থ ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিংয়ের বিষয়ে আপনারা কোনো ওয়ার্কশপ করেছিলেন কিনা? জনাব হায়দার আমাকে জানান, তারা কোনো ওয়ার্কশপ করেননি। তবে এখান থেকে বাংলাদেশে আলোচনা অনুষ্ঠান করবেন। তিনি যোগ করেন, এই ওয়ার্কিং গ্রুপ মিটিংগুলো এটেন্ড করার জন্য কমপক্ষে ৪ জন প্রতিনিধির প্রয়োজন হয়। তারা এসেছেন মাত্র ২ জন।

আমি প্রশ্ন করেছিলাম বাংলাদেশ কি জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ইস্যুকে সমান গুরুত্ব দেয়? এই প্রশ্নের জবাবে জনাব হায়দার জানান, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেটা সঠিকভাবেই দেয়া হচ্ছে, কিন্তু সেটির পাশাপাশি আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও প্রশমন কাজ সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবো না। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ সরকার একে একে সেদিনে এগিয়ে যাচ্ছে।

জনাব হায়দার আরও যোগ করেন, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ এই ৪র্থ মিটিং চাচ্ছে, যে এই টার্গেটগুলো বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের সামর্থ অর্জন করা দরকার। বাংলাদেশের ফিন্যান্সিয়াল সিসোর্স মোবিলাইজেশন দরকার। বাংলাদেশ বলছে যে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেন বায়োডাইভারসিটি টার্গেট বাস্তবায়নে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসে। একইসাথে এই টার্গেটগুলো বাস্তবায়নের জন্য যেন একটি গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফান্ড গঠন করা হয়। যেন পোস্ট-২০২০ ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন করা যায়। উন্নত দেশগুলো বিশ্বের সকল দেশ তার জিডিপি এর ১% অর্থাৎ প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার এই বায়োডাইভারসিটি সংরক্ষণে ব্যয় করা হয়।

চড়া মূল্য দিতে হবে বিশ্বের দেশগুলোকে
ফিরে যাই ব্রাইয়ান ও’ ডোনেল এর কথায়, যিনি ক্যাম্পেইন ফর নেচারের পরিচালক। ডোনেল বলছেন, এটা একটা চ্যালেঞ্জ কারন বিজ্ঞানীরা মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার মূখ্য উদ্দেশ্য হল পৃথিবীর সব প্রাণীকে বাচিয়ে রাখা। সারা বিশ্বের মানুষদের ওপর এটা চ্যালেঞ্জ যে তাদের সরকার প্রধান, লিডার মিডিয়ার সাথে কথা বলা উচিত যে বায়োডায়ভারসিটি কোন সহজ জিনিস নয় যে এটা চাইলেই পাওয়া যাবে এটাকে রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বায়োডায়ভারসিটি রক্ষা করা জরুরী আমাদের খাবার, আমাদের নিশ্বাস, আমাদের পানি পানের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে। আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বিষয়টির মত জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি সমান গুরুত্ব না দেই, তাহলে অদূল ভবিষ্যতে আমাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিজেনাস ফোরাম এন বায়োডায়ভারসিটি এর জেনিফার করপাজ, যিনি এই নাইরোবি কনফারেন্সে বিভিন্ন এনজিও ও এডভোকেসি গ্রুপকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি বলেন, গ্লাসগোতে কপ সম্মেলনে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ন্যাচার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সংযোগকে। এবং একইসাথে টার্গেট-৮ যা স্বীকৃতি দিয়েছে ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং বায়োডাইভারসিটির সংযোগকে। এই দুটোর সংযোগ আরও পরিষ্কার ও কমিউনিকেটিভ হওয়া উচিত।

সংবাদ সম্মেলেনে গেবনের (গেবন এমন একটি দেশ, যেটি বায়োডাইভারসিটির বেশিরভাগ টার্গেট পূরণ করেছে) পরিবেশ মন্ত্রী স্টানিসলাস স্টিফেন মওবা গুরুত্ব দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন থেকেও বায়োডাইভারসিটি ইস্যু মোকাবেল করা আরও জটিল বিষয় এটা দেশগুলোতে বুঝতে হবে।

[This story was produced as part of a reporting fellowship to the 2022 UN Convention on Biological Diversity’s 4th Meeting of the Open-ended Working Group on the Post-2020 Global Biodiversity Framework, led by Internews’ Earth Journalism Network.]

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply