মাহবুবুর রহমান রিপন, সিলেট
সিলেটে সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে জিরো পয়েন্ট থেকে রাতের আঁধারে পাথর বিক্রির অভিযোগ উঠেছে খোদ বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের বিরুদ্ধে। পাথর কোয়ারি থেকে প্রতিরাতে ৩০ লাখ টাকা নেন বিজিবি কমান্ডার। এদিকে পাথর বিক্রির ঘটনা উপজেলা প্রশাসন হাতে নাতে ধরেও কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। চলছে শুধু চিঠি চালাচালি। এই সুযোগে প্রতিরাতে কমপক্ষে কোটি টাকার পাথর লুট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খ্যাত ভোলাগঞ্জ, বিছানাকান্দি আর জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিরাতে ১ হাজার থেকে ১২’শ নৌকা প্রবেশ করে জিরো পয়েন্টে এবং প্রতি নৌকা থেকে ৩ হাজার টাকা করে নেন বিজিবি সদস্যরা। সেই হিসাবে প্রতিরাতেই ৩০ লাখ টাকা নেন তারা। আর এ কাজে বেপরোয়া ভুমিকা পালন করছেন ৪৮ ব্যাটালিয়নের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ক্যাম্পের কমান্ডার আইয়ুব আলী। কেউ তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেই তিনি নাম ভাঙ্গান সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের। যাতে করে ভয়ে আর কেউ কিছু না বলতে পারেন। এমন একটি অডিও ক্লিপ নিয়ে তোলপাড় চলছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। অডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, সেক্টর কমান্ডার তার কিছুই করতে পারবে না। স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার সাথে এই কোম্পানি কমান্ডারের অডিও ক্লিপ ইতোমধ্যে প্রশাসনসহ বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে।
সীমান্ত আইন অনুযায়ী, ভারত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী ২০০ গজ জিরো পয়েন্ট এলাকায় জনসাধারণ প্রবেশ কিংবা পাথর উত্তোলন নিষেধ এবং এ এলাকার দেখভালের দায়িত্ব সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভোলাগঞ্জ, বিছানাকান্দি আর জাফলং এ পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য জিরো পয়েন্ট এর পাথর সরানো সম্পূর্নরূপে অবৈধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
কিন্তু দীর্ঘদিন এ আইন চলতে থাকলেও গত ১৫ দিন ধরে হঠাৎই পাল্টে যায় চিত্র। প্রথমে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির কালাসাদেক ক্যাম্পের (পাথর কোয়ারী ক্যাম্প) কোম্পানি কমান্ডার মো: আয়ুব আলী জিরো পয়েন্টে পাথর বাহী নৌকা প্রবেশের সুযোগ দেন। এর জন্য প্রতি নৌকা বাবদ ৩ হাজার টাকা করে নেন তিনি।
এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষিপ্ত হোন স্থানীয় একটি শ্রমিক সংগঠন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পাথর উত্তোলন এবং বহনকারী শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং:২২৬৩) এর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মিয়া, গত ৩০ মে কমান্ডার আইয়ুব আলীর বিরুদ্ধে প্রতিরাতে ৩০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে বিভাগীয় কমিশনার এবং বিভিন্ন দফতরে স্মারক লিপি প্রদান করেন। সেই সাথে আইয়ুব আলীকে কালাসাদেক ক্যাম্প থেকে প্রত্যাহারের দাবী জানান। এর পরই তদন্তে নামে উপজেলা প্রশাসন। গত ০২ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দফতর থেকে এক পত্র পাঠানো হয় জেলা প্রশাসক বরাবর।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ০৫.৬০.৯১২৭.০০৩.৩৩.০৭৩.১৮-৬১৮ স্মারক পত্রে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল লাইছ উল্লেখ করেন যে, গত ১ জুন রাত সাড়ে ১১ টায় তিনি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। সে সময় শত শত পাথর বাহী নৌকা জিরোপয়েন্ট থেকে পাথর উত্তোলন করছিল। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, তিনদিকে ভারত সীমান্ত বেষ্টিত পকেট সদৃশ এ স্থানের প্রায় ৫০০ গজ পূর্বে বিজিবির একটি বিওপি রয়েছে এবং এই বিওপি অতিক্রম করে সেই নিষিদ্ধ জিরো পয়েন্টে যেতে হয়। দিনের বেলা উল্লেখিত বিওপি থেকেই জন সাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু রাতের বেলা শ্রমিকদের নৌকা নিয়ে এই সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ এবং পাথর উত্তোলনে বাধা প্রধান করা হচ্ছে না।
এছাড়া স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতি নৌকায় অর্থের বিনিময়ে বিজিবি পাথর উত্তোলনের সুযোগ দিচ্ছে এবং এভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে ভোলাগঞ্জের জিরো পয়েন্টের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়েছে। সাথে সাথে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে এবং কিছু বিজিবি সদস্যের ভুমিকা নিয়ে বিরুপ মনোভাব দেখা দিয়েছে। তাই দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানানো হলো।
কোম্পানী কমান্ডার আইয়ুব আলীর কাছে মোবাইলে রাতের আঁধারে লাখ লাখ টাকার পাথর বিক্রির কথা জানতে চান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সরকারদলীয় এক ছাত্র নেতা। সেই ফোনকলের অডিও ক্লিপে শোনা যায়, শুরুতেই আইয়ুব আলী তাকে আপনি বলে সম্ভোধন করলেও একটু পরেই চলে আসেন তুমিতে। তারপর টাকা নিয়ে পাথর বিক্রির কথা জিজ্ঞাসা করলে আয়ুব আলী বলেন “অবশ্যই টাকা নিচ্ছি, হান্ডেড পার্সেন টাকা নিচ্ছি, আর কিছু জানার আছে?। সেই ছাত্র নেতাটি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, এটা করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে কোম্পানি কমান্ডার জানান, এটা তিনি করছেন না, আওয়ামীলীগের বড় নেতাদের জিজ্ঞাসা করেন তারা জানেন কে করছেন। এ সময় তিনি বলেন, নাম নিবে তুমি, আমি বলি এটা হুকুম দিয়েছে… (দুটি নামের কথা উল্লেখ করেন) পারলে তাদের সাথে কথা বল। এ সময় ছাত্র নেতাটি এসব কথা রেকর্ড করছেন বললে, তিনি তাকে গালি গালাজও করেন। এবং বলেন, তুই পারলে সেক্টর কমান্ডারকে গিয়ে এসব শোনা। আমার কিছুই যায় আসে না।
এসব বিষয় নিয়ে যমুনা নিউজের সাথে আলাপকালে কোম্পানি কমান্ডার মো: আইয়ুব আলী বলেন, এখানে যা হচ্ছে সরকারের নির্দেশেই হচ্ছে তার সিদ্ধান্তে কিছু হচ্ছে না। সরকার বলতে কাকে বোঝাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একদিন বেড়াতে আসেন দাওয়াত করছি তাহলেই সব বুঝে যাবেন। সেই অডিওর প্রসঙ্গ আনতেই ফোন কেটে দেন তিনি।
অন্যদিকে ভোলাগঞ্জে জিরো পয়েন্টের পাথর হরিলুটের সাথে সাথে শুরু হয়েছে বিছানাকান্দি এবং জাফলং জিরো পয়েন্টেরও পাথর লুট। সেখানকার বিজিবি কামান্ডারও স্থানীয়দের সাথে মিলে একই কাজ করছেন বলে জানা যায়। রাতের আঁধারে জিরো পয়েন্টে নৌকা ঢোকার সুযোগ দিয়ে প্রতি নৌকায় হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩ হাজার টাকা। এ নিয়েও চিঠি দিয়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
০৫.৪৬. ৯১৪১.০০৮.০৫.০০১.১৪ স্মারকে জেলা প্রশাসক বরাবর দেয়া চিঠিতে ইউএনও বিশ্বজিৎ কুমার পাল উল্লেখ করেন, সীমান্ত রক্ষাণাবেক্ষণ আইন অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ২০০ গজের মধ্যে পাথর উত্তোলন কিংবা জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু রাতের আঁধারে বিছানাকান্দি এবং জাফলং বিওপির ১০০ গজের মধ্যে এই দুই জিরো পয়েন্ট থেকে পাথর উত্তোলন করতে শত শত নৌকা প্রবেশ করছে। যা কোন ভাবেই কাম্য নয় এবং সম্পূর্ন অবৈধ। প্রতিবেদনে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে, সিলেটে বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে.কর্নেল মহসিনুল কবির মঙ্গলবার জানান, তিনি বিষয়টি জানেন না, জেনে তার পর কথা বলবেন এর জন্য একদিন সময় চান তিনি। বুধবার তিনি জানান, আপনাদের তথ্য আমাদেরকে সহায়তা করেছে। বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখছি। ইতোমধ্যেই সেই কোম্পানি কমান্ডার আইয়ুব আলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া বিষয়টি বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এছাড়া বিছানাকান্দি ও জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে লে. কর্নেল মহসিনুল কবির বলেন, সে বিষয়ে জানা ছিল তাই দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক নুমেরী জামান জানান, তারা এ ঘটনা শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে কথা বলছেন কিন্তু এটা থামানো যাচ্ছে না। বিষয়টি যেহেতু সীমান্ত এলাকায় তাই বিজিবিকেই এর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
Leave a reply