মাত্র ২৮ বছর বয়সে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের ব্রত নিয়ে ১৯৫৩ সালে ৭ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে আসেন ফাদার মারিনো রিগন। তারপর ফাদারের জীবন কেটেছে বাংলার আলো, হাওয়ায়। এই দেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে নিজ অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করেছেন। তারপর ২০১৮ সালে আবার একবার মোংলায় ফেরেন তিনি। সেবার বাংলাদেশে আসে তার মরদেহ। মৃত্যুর আগে তিনি কেবল চেয়েছিলেন, মোংলায় শেলবুনিয়া চার্চে যেন তার সমাধি হয়। ভিনদেশিদের ভালোবাসায় অনেকবারই সিক্ত হয়েছে এ দেশ। ফাদার রিগন তাদের মধ্যেও বিশেষ। বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পেয়েছেন বাঙালির এই পরম বন্ধু।
বাংলাদেশের বন্ধু ফাদার রিগনের জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালে ৭ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে আসেন। কর্মসূত্রে সুন্দরবনের কাছে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন তিনি। তবে কেবল ধর্মযাজকের পরিচয়েই আটকে থাকেননি তিনি। মানবতাবাদী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই দিনশেষে হয়ে দাঁড়ায় তার বহু পরিচয়ের মাঝেও বিশেষ।
১৯৭১ সালে ফাদার রিগন ছিলেন ফরিদপুর জেলার বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ধর্মযাজক। পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, আর হানাদারদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া গ্রামের পর গ্রাম তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। ফাদার তখন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন চিকিৎসাসেবা। এর পাশাপাশি যুদ্ধপীড়িতদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, ফাদার রিগনের কাছে চিকিৎসা পেয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন।
ইতালিয়ান ভাষায় তিনি অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ চল্লিশ কাব্য, জসীমউদদীনের নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা, লালনের তিনশো পঞ্চাশটি গান ছাড়াও বাংলাদেশের অসংখ্য কবিতা। তিনি ইতালীয় রূপকথা পিনোকিও অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষায়। এছাড়াও, ফাদার রিগন রচিত মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল্যবান ইতিহাস। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর ফাদার রিগন তার লেখা মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি, মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেন।
ফাদার রিগন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও অগণিত দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের স্পন্সরশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন পড়াশোনার সুযোগ করে দেন তিনি। মানবসেবা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রদান করেছে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। পেয়েছেন বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’।
অত্যন্ত বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় চলৎশক্তিহীন ফাদার রিগনকে ইতালি ফিরিয়ে নিয়ে যান তার আত্মীয়রা। অবশেষে তিরানব্বই বছর বয়সে ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৭ সালের এইদিনে জীবনের মায়া ত্যাগ করেন ফাদার মারিনো রিগন। পরিবারকে জানিয়ে গিয়েছিলেন, শেষ নিঃশ্বাসও বাংলার আলো হাওয়ায় ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন এই মাটিতেই সমাধিস্থ হতে। তার সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। বাংলার বন্ধু ফাদার রিগন তার পবিত্র অস্তিত্ব নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন বাংলার মাটিতে। দেবতাসম এমন মানুষ ও বাংলাদেশের এই পরমবন্ধুর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
/এম ই
Leave a reply