‘ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো’- কথাটি তিনি প্রায়ই বলতেন। শুধু কি বলতেন? না। কাজের মাধ্যমে দেখাতেনও। সেই কাজ নাটক, সেই কাজ চলচ্চিত্র। নাটক আর চলচ্চিত্রের গল্পে, চিত্রপটে তিনি মানুষকে ভাবাতেন। ভাবতে শেখাতেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের সঙ্গে তার নাম আজও উচ্চারিত হয়। মাত্র ৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি যে অসামান্য খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তা অবিশ্বাস্যও বটে! তিনি ঋত্বিক কুমার ঘটক। আজ উপমহাদেশের এ কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকারের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী।
দেশভাগের যন্ত্রণা যে কজনকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ঋত্বিক ঘটক তাদের অন্যতম। তার একের পর এক সিনেমায় সে ছাপ স্পষ্ট। বাংলাভাগ, গণনাট্য আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনৈতিক অশান্তি, শরণার্থীদের যন্ত্রণার তীব্রতার ছাপ তার প্রায় সকল সিনেমাতেই লক্ষণীয়।
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের রাজশাহী শহরের মিয়াঁপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক। ছেলেবেলায় কিছুদিন দাদা মণীশ ঘটকের সঙ্গে কলকাতায় ছিলেন তিনি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজশাহীতে ফিরে আসেন। সেখানেই তার পৈতৃক বাড়িতে শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের একটি অংশ কাটে। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়।
১৯৫৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন ঋত্বিক। কিন্তু এমএ সম্পূর্ণ না করেই তিনি পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন। কারণ তার কাছে তখন ডিগ্রির চেয়ে লেখক হওয়া বেশি জরুরি ছিল। সে সময় তিনি দেশ, শনিবারের চিঠি, অগ্রণী বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন।
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পত্রিকার পাশাপাশি মঞ্চ নাটককে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ঋত্বিক। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম নাটক লিখেন ‘কালো সায়র’। ১৯৫১ সালে ঋত্বিক ঘটক ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। তিনি অসংখ্য নাটক রচনা করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অভিনয়ও করেছেন।
১৯৫২ সালে তিনি ‘দলিল’ শিরোনামে একটি নাটক নির্মাণ করেন; নাটকটি ১৯৫৩ সালে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন এক্সিবিশনে প্রথম পুরস্কার লাভ করে। আর চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের আবির্ভাব ঘটে পরিচালক নিমাই ঘোষের হাত ধরে।
১৯৫০ সালে নিমাইয়ের সিনেমা ‘ছিন্নমূল’-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে ঋত্বিকের। এ সিনেমায় তিনি একইসঙ্গে সহকারী পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় ‘অযান্ত্রিক’ । সুবোধ ঘোষের একটি ছোটগল্প অবলম্বনে এটি নির্মাণ করেন ঋত্বিক। একজন মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক নিয়েই তৈরি এ সিনেমা। সেসময় পুরো ভারত জুড়েই অন্যরকম আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল অযান্ত্রিক।
ষাটের দশকে স্বল্প সময়ের জন্যে পুনেতে বসবাস করতে শুরু করেন ঋত্বিক। ১৯৬৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে সেখানকার ভাইস-প্রিন্সিপালও হন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন।
এরও প্রায় এক যুগ পর ১৯৭২ সালে আবার চলচ্চিত্রে ফেরেন ঋত্বিক। এ সময় তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেন।
তবে এ সবকিছুই থেমে যায় ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। মাত্র ৫০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম এ ধ্রুবতারা। সারাজীবন তিনি কাজ করেছেন নিজের তাড়নায়। জনপ্রিয়তার মোহে তিনি চলচ্চিত্র তৈরি করেননি, কাজ করেছেন নিজের মতো করে। চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালির মানস্পটে অসাধারণ সব সিনেমার রূপকার হিসেবে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শুভ জন্মদিন ঘটক বাবু।
/এসএইচ
Leave a reply