সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস; দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সারার নাম

|

মরনোত্তর কিডনি ও কর্নিয়া দানকারী সারা ইসলাম বাংলাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ব্রেন ডেথ রোগীর অঙ্গদানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ক্যাডাভেরিক কিডনি ও কর্ণিয়া ট্রান্সপ্ল্যান্ট অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এতে নতুন ইতিহাস রচিত হলো দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে। একইসাথে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রথম অঙ্গদাতা হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইতিহাস তৈরি করলেন সারা ইসলাম (২০)। বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে সারার নাম। 

বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) বিকেল ৩টায় বিএসএমএমইউ এর শহীদ ডা. মিল্টন হলে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও জাতীয় ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ এসব তথ্য জানান।

অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, সারা ইসলামের এ মহান আত্মত্যাগ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরভাস্মর হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে এবং অঙ্গগ্রহণের মাধ্যমে নতুন জীবন পাবেন রোগীরা।

তিনি জানান, অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদের সার্বিক নির্দেশনা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন, ইউরোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুর রহমান দুলালের নেতৃত্বে অ্যানেসথেসিয়া, এনালজেসিয়া এবং ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের সার্বিক সহযোগীতায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সফল ক্যাডাভেরিক বা ব্রেন ডেথ রোগীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বুধবার (১৮ জানুয়ারি) সমস্ত রাতব্যাপী ঐতিহাসিক এ অপারেশন সম্পন্ন হয়।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, বুধবার (১৮ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে দশটায় কেবিন ব্লকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশন থিয়েটারে রোগীর অপারেশন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলালের নেতৃত্বাধীন একটি চিকিৎসক দল। অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবাশীষ বণিক ও অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিকের নেতৃত্বে সিনিয়র এনেসথেসিওলজিস্ট অপারেশন পরিচালনা করেন। জটিল এ অপারেশন শেষ হয় ভোর সাড়ে চারটার দিকে।

ঐতিহাসিক এ অপারেশনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল হোসেন দিপু, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, সহকারী অধ্যাপক ডা. কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, অ্যানেসথেসিয়া অ্যানালজেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবাশিষ বনিক, অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক, সহযোগী অধ্যাপক ডা. দিলীপ ভৌমিক, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আশরাফুজ্জামান সজিব, সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল হান্নান, কনসালট্যান্ট ডা. মোমিনুল হক, সিনিয়র রেসিডেন্টবৃন্দ ও মেডিক্যাল অফিসারবৃন্দ। এ সময় নেফ্রোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং সহকারী অধ্যাপক ডা. মানিক মণ্ডলও উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, সারা ইসলামের দুটি কিডনির একটি মিরপুরের বাসিন্দা শামীমা আক্তার (৩৪) এর দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে অপর কিডনিটি প্রতিস্থাপন করা হয় কিডনি ফাউন্ডেশনের অপর এক রোগীর দেহে।

আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিডনি ও কর্নিয়া দানকারী সারা ইসলামের চিকিৎসার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ডা. কামরুল হুদা। এ সময় রোগ নির্ণয় ও পরবর্তীতে অঙ্গদানের মহৎ উদ্যোগে সারার মা শবনম সুলতানাকে উদ্বুদ্ধ করেন ক্যাডাভেরিক সেলর সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ এর সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুজ্জামান সজীব। পরবর্তীতে ডা. সজিব ট্রান্সপ্ল্যান্ট মেডিক্যাল টিমকে বিষয়টি  অবহিত করেন এবং পুরো প্রক্রিয়া শুরু হয়।

স্কুল শিক্ষিকা মা শবনম সুলতানা এবং বাবা শহীদুল ইসলামের বড় সন্তান ছিলেন সারা ইসলাম। সারার একটি ছোট ভাই আছে। জন্মের মাত্র ১০ মাসের মাথায় দুরারোগ্য টিউবেরাস স্কে¬রোসিস রোগে আক্রান্ত হন সারা। তিনি এ রোগ নিয়ে প্রায় ১৯ বছর ধরে লড়াই করেছেন । এ লড়াই চলাকালীন সময়েই অগ্রনী গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি ও হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সারা। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি অব ডেভলভমেন্ট আল্ট্রারনেটিভে (ইউডা) ফাইন আর্টসে ভর্তি হন। সারা ফাইন আর্টসের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় বিএসএমএমইউ এর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে প্রয়াত সারা ইসলামের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ সারার জানাজায় শরীক হন। তারা প্রয়াত সারার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। এরপর তাকে পারবারিকভাবে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে ব্রেন ডেথ কমিটিকে সক্রিয় করে তুলি। আমরা বিশ্বাস করি, ক্যাডাভেরিক রোগী অঙ্গদানের মাধ্যমে অসংখ্য অসুস্থ্য রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে মানবদেহে অঙ্গপ্রতিস্থাপন সংক্রান্ত আইন জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেন ডেথ কমিটি ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সেলের সহযোগীতায় ক্যাডাভেরিক রোগীর দেহ থেকে অঙ্গদানের প্রক্রিয়া সফল করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর আগে, আমরা এ ধরনের দু-একটি রোগীর অপারেশন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, কাউকেই অঙ্গদানে রাজি করাতে পারিনি। কিন্তু, আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা সফল হয়েছি। বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছি।

এজন্য  বিশ্ববিদ্যালয়ের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সেলের প্রধান, ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল ও তার টিমকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান উপাচার্য।

উপাচার্য আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই চিকিৎসাক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের উদ্যোগ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এরইমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ‘মুজিব শতবর্ষ লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট প্রোগ্রাম” সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। রোবটিক সার্জারি চালুর ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক চিকিৎসককে বিদেশে রোবটিক সার্জারির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কাটাছেড়া ছাড়া ভেরিকোজ ভেইন সোজাকরণের অত্যাধুনিক মেশিনও চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কাজকে আরও বেগবান করতে এ খাতে বরাদ্দ পাঁচগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গবেষণা খাতে বরাদ্দ ৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২ কোটি ২০ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে ২৪ চিকিৎসক গবেষককে পিএইচডি কোর্সে এনরোলমেন্ট করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, প্রক্টর ও ইউরোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুর রহমান দুলাল, কিডনী ফাউন্ডেশনের পথিকৃৎ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ, ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রথম অঙ্গদাতা সারা ইসলামের মা শিক্ষিকা শবনম সুলতানা প্রমুখসহ ইরোলজি বিভাগ, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ ও কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগের চিকিৎসকেরা উপস্থিত ছিলেন।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply