চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সাংবাদিক- প্রতিটি পরিচয়েই সুপরিচিত তিনি। এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল তার সরব পদচারণা, পরিচয় দিয়েছেন পারদর্শিতার। তবে সব ছাপিয়ে তিনি একজন কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এবং জীবনস্পর্শী প্রতিবাদী সাহিত্য ধারার এক গুণী শিল্পীর নাম জহির রায়হান। আজ ৩০ জানুয়ারি গুণী এ চলচ্চিত্র নির্মাতার অন্তর্ধান দিবস। ১৯৭২ সালের এ দিনে ঢাকার মিরপুর থে০কে নিখোঁজ হন তিনি।
তার পুরো নাম- আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ, ডাক নাম জাফর। তবে মানুষের কাছে তিনি জহির রায়হান নামেই খ্যাত। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্ম তার। ১৯৪০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখানেই বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন জহির। ছাত্রজীবনেই সাংবাদিক হিসেবে শুরু হয় তার কর্মজীবন। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’। তার রচিত কালজয়ী উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আরেক ফাল্গুন, বরফ গলা নদী ও আর কতদিন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১০ জনের যে দলটি সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিল, জহির রায়হান তাদেরই একজন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও ক্যামেরা হাতে সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। চলচ্চিত্রে তার আগ্রহ সে সময় থেকেই।
১৯৫৭ সালে পরিচালক এ জে কারদারের সহকারী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন জহির রায়হান। ১৯৬০ সালে ‘কখনো আসেনি’ সিনেমা দিয়ে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন জহির। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় পাকিস্তানের প্রথম রঙিন সিনেমা ‘সঙ্গম’। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’। এরপর, একে একে নির্মাণ করেন সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, আনোয়ারা, জীবন থেকে নেয়া’র মতো কালজয়ী সিনেমা।
১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেয়া’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত। এ সিনেমায় রূপক আকারে তুলে ধরা ভাষা আন্দোলন তার ওপর এতোটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় তিনি চলে যান ওপার বাংলায়। সেখানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার অভিযান শুরু করেন। পাকবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরি করেন প্রামান্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
বাংলা সাহিত্যে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে জহির রায়হান ভূষিত হন বাংলা একাডেমি পদকে। ১৯৬৫ সালে ‘কাঁচের দেয়াল’ সিনেমার জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসরকারি সম্মাননা ‘নিগার পুরস্কার’-লাভ করেন শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে। ১৯৭২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘জীবন থেকে নেয়া’ ও ‘স্টপ জেনোসাইড’ বিশেষ পুরস্কার লাভ করে।
তার জীবনের পরিধি ছিলো মাত্র ৩৭ বছর। ক্ষুদ্র এ জীবনে একজন মানুষ কতোটা দিতে পারেন, জহির রায়হান ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি। এমনকি পাওয়া যায়নি তার মৃতদেহও। তবে, চলে গেলেও তার রেখে যাওয়া কাজ গেঁথে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।
/এসএইচ
Leave a reply