‘দাবা-ই জীবন’। ক্যাথরিন নেভিলের ‘দ্য এইট’ নামক উপন্যাসটির শুরুতে ববি ফিশারের বিখ্যাত এই উক্তি চোখে পড়বে। থ্রিলারধর্মী এই উপন্যাসে দুইশ বছরের ব্যবধানের দুইটি টাইমলাইনে পদার্থ, রসায়ন, গণিত, সংগীত ও দাবার মিশেলে এগিয়ে চলে গল্প; এগিয়ে চলে নাটকীয়তা।
প্রশ্ন আসতে পারে, ভূমিকা পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ দাবা প্রতিভা ববি ফিশারের নাম উল্লেখ করে প্রাসাদের সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন ক্যাথরিন নেভিল? রবার্ট জেমস ফিশারের জীবনকে নাটকীয়তার পারদে অন্যতম সর্বোচ্চ আসন ছেড়ে না দিয়ে যে উপায়ও নেই!
শিকাগোতে জন্ম ববি ফিশারের, বেড়ে উঠা ব্রুকলিনে। আইসল্যান্ডের রেইকাভিকে ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যু। এর মাঝেই কিংবদন্তির চরিত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। সর্বকালের অন্যতম সেরা দাবা প্রতিভা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম ক্রীড়নকে পরিণত হওয়া এই দাবাড়ু জীবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন অনেকটা যেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। জন্মসূত্রে আমেরিকান ইহুদি হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের চাঁছাছোলা সমালোচক ছিলেন তিনি। সেই সাথে ইহুদি বিদ্বেষকে নিজ চরিত্রের ধ্রুবক বৈশিষ্ট্যের রূপও দেন ফিশার। তবে সেটাও অনেক সময় ছাপিয়ে গেছে অনেকের বোধের মাত্রা।
ফিলিপাইনের একটি রেডিও স্টেশনে ১৯৯৯ সালে কয়েক দফা সাক্ষাৎকারে ফিশার অসংলগ্নভাবে একটি আন্তর্জাতিক ইহুদি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলেন। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে তিনি বর্ণনা করেছিলেন ‘দারুণ খবর’ হিসেবে। মার্কিন সেনাবাহিনী দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইহুদিদের সব উপাসনালয় বন্ধ করে দেবে; সকল ইহুদিদের গ্রেফতার ও হত্যা করা হবে— এ রকম অনেক আশাও তিনি নাকি করতেন!
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কেবল সবচেয়ে শক্তিশালী দাবাড়ু-ই ছিলেন না ববি ফিশার, ছিলেন অন্যতম রহস্যময় চরিত্র। খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে উঠে যাওয়ার পর তিনি একরকম ছেড়েই দেন প্রতিযোগিতামূলক দাবা! টাকা-পয়সা খুইয়ে বন্ধুবান্ধব হারিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান বুদাপেস্ট, জাপান; হয়তো ফিলিপাইন, সুইজারল্যান্ডেও। শেষে আইসল্যান্ডেই থাকতেন ববি ফিশার, নাগরিকত্বও নেন সেখানকার।
৬ বছর বয়সে প্রথম দাবার বোর্ড উপহার পান ববি ফিশার। তার বোন জোয়ান বোর্ডটি কিনে ফিশারকে শিখিয়ে দেন মৌলিক নিয়মগুলো। ব্রুকলিন চেজ ক্লাবে আট বছর বয়স থেকেই ক্লাস নিতে শুরু করেন ফিশার। আর মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি পৌঁছে যান আমেরিকার শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুদের কাতারে। ১৯৫৬ সালে ১৩ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটস জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন ববি ফিশার। একই বছর আন্তর্জাতিক চেজ মাস্টার ডোনাল্ড বার্নকে হারিয়ে দাবায় ববি ফিশার উপহার দেন নিজের প্রথম মাস্টারপিস পারফরমেন্স। দ্য চেজ রিভিউ এর দৃষ্টিতে সেই ম্যাচটিকে বলা হয় ‘দ্য গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’। ম্যাচটিকে একইভাবে এখনও মনে রেখেছে দাবা দুনিয়া।
পরের বছর মার্কিন জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পুনরাবৃত্তি তো তিনি করেনই, সেই সাথে প্রথমবারের মতো ইউনাইটেড স্টেটস চ্যাম্পিয়নশিপও জিতে নেন ফিশার। ১৪ বছর বয়সে এই টাইটেল জিতে সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। আমেরিকার তখনকার শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুদের বিরুদ্ধে তিনি ১৩টি ম্যাচ খেলে ৮টিতে জয় পান, ড্র করেন ৫টি। কোনো ম্যাচ হারতে হয়নি তাকে। এরপর আরও সাতবার এই চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেন তিনি। হ্যাঁ, প্রতিবারের চ্যাম্পিয়নের নামই এক, ববি ফিশার। পরের বছর ১৫-তে পদার্পণ করেন ববি ফিশার। এ বছরই তৎকালীন সময়ের হিসেবে সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে ফিশার পান দাবায় পারদর্শীতার সর্বোচ্চ খেতাব, গ্র্যান্ডমাস্টার।
দাবা বোর্ডের সামনে চরম আগ্রাসন ছিল ফিশারের ট্রেডমার্ক। প্রতিপক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না তিনি। বলতেন, ওদের গলদঘর্ম হওয়া দেখতে আমি খুব পছন্দ করি। দাবা বোর্ডে ফিশারের প্রিয় কৌশল ছিল কিংস গ্যাম্বিট। এটা হচ্ছে শুরুর চাল, যেখানে-যেখানে সাদাপক্ষের খেলোয়াড় রাজার ‘পন’ ছেড়ে দেয়, যাতে প্রতিপক্ষ রচনা করে দ্রুত আক্রমণ। মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও ‘রোম্যান্টিক’ বলে কৌশলটি দীর্ঘসময় ধরে বাতিলের খাতায়ই ফেলে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেখানেই চলে আসেন ববি ফিশার। ১৯৬৪ সালের মার্কিন চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত দক্ষতার সাথে গ্র্যান্ডমাস্টার ল্যারি ইভান্সের বিরুদ্ধে ‘কিংস গ্যাম্বিট’ ব্যবহার করে তাবৎ দাবা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেন ফিশার। দাবা শিক্ষক ও লেখক ব্রুস পেন্ডলফিনি বলেন, দাবা জগতকেই এলোমেলো করে দিয়েছে সে।
এই টুর্নামেন্টে ফিশারের খেলাকে ধরা যেতে পারে কোনো আসরে অন্যতম সেরা পারফরমেন্স হিসেবে। ১১টি ম্যাচে জয় পান ফিশার। নেই কোনো হার বা ড্র। এখানেই গ্র্যান্ডমাস্টার রবার্ট বার্নের বিরুদ্ধে আরেকটি কিংবদন্তিতুল্য ম্যাচ খেলেন ফিশার। বার্ন যখন ম্যাচটা ছেড়ে দিলেন, তখনও কাগজে-কলমে তিনিই এগিয়ে ছিলেন। এই ম্যাচের ফলাফল এতটাই অস্বাভাবিক ছিল যে, দাবা বিশ্লেষকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে রবার্ট বার্ন বলেন, ফিশারের অন্যতম সেরা কাউন্টার অ্যাটাকের নিদর্শন ছিল সেই ম্যাচ। কালো নিয়ে খেলছিল সে। বেশ বড় ধরনের ত্যাগ স্বীকার করে নেয় সে। তার পরিকল্পনা এতটাই গভীর ছিল যে, তা ছিল আমার বোধের বাইরে। তার সমগ্র বিন্যাসকে কেবল বলতে হয়, অনিন্দ্য সুন্দর।
ববি ফিশার আজীবনই ছিলেন ঔদ্ধত্য স্বভাবের মানুষ। ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে নিজেকে নিয়ে তার গর্ব বেড়ে যায় অনেকটা দ্রুত। হার্পারস ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছিলেন, নারীরা ভালো দাবাড়ু হতে পারে না। পুরোনো একটি ঘটনা প্রসঙ্গে রবার্ট বার্ন জানান, ১৯৬২ সালে বুলগেরিয়ায় বার্ন ফিশারকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফিশার উত্তরে বলেছিলেন, তার মাথা নিয়ে কাজ করার সৌভাগ্য যে অর্জন করবে, সেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরই উচিত হবে ফিশারকে টাকা দেয়া।
এ অবস্থায়ই বেশ কিছু উদ্ভট আবদার করে বসেন ববি ফিশার। টুর্নামেন্ট পরিচালকদের কাছে বিশেষ আলো, বিশেষ আসন, কিংবা সম্পূর্ণ নীরবতার ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানাতেন এই দাবা প্রডিজি। অস্বাভাবিক সব দাবিও করে বসতেন ফিশার। অভিযোগ করলেন, তার খাবারে বিষ মেশানোর চেষ্টা করছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা! ফিশারের হোটেল কক্ষে নাকি বসানো হয়েছে আড়ি পাতার যন্ত্র। কিংবা, রাশিয়ান দাবাড়ুরা কেবল তাকে জয়বঞ্চিত করতেই পরিকল্পনামাফিক একের পর এক গেম ড্র করে চলেছেন। প্লেনে উঠতেও গড়িমসি শুরু করলেন ববি ফিশার। তার ভয়, রাশিয়ানরা নাকি বিমানে বুবিট্র্যাপ রেখেছে!
প্রতিযোগিতামূলক খেলায় ধীরে ধীরে অংশগ্রহণ কমিয়ে দেন ববি ফিশার। গুঞ্জন শুরু হয়, হেরে যাওয়ার ভয়েই হয়তো খেলতে চাচ্ছিলেন না তিনি! কিন্তু যেভাবে প্রতিবার ফিরেছেন, প্রমাণ করেছেন যে, তার মানের সাথে মিলতে পারেনি সমসাময়িক অন্য কোনো খেলোয়াড়ই। রেইকাভিকে বরিস স্পাসকির বিরুদ্ধে খেলার আগে গ্র্যান্ডমাস্টারদের বিরুদ্ধে একটানা ২০টি ম্যাচ জিতেছিলেন ফিশার। ১৯৬৯ সালে ‘মাই সিক্সটি মেমোরেবল চেজ গেমস’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন তিনি। দাবায় পারদর্শীতা অর্জন করতে চায়, এমন খেলোয়াড়দের জন্যও বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।
তখন দুনিয়াজোড়া চলছে স্নায়ুযুদ্ধের আতঙ্ক। বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে ৩৫ বছর ধরে চলছে সোভিয়েত রাজত্ব। ১৯৭২-এ আইসল্যান্ডের রেইকাভিকে ববি ফিশার আর তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়নের বরিস স্পাসকি দাবার বোর্ডে বসেন, তাদের নিজস্ব স্নায়ুযুদ্ধে। এতদিন মুখে মুখে নিজেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করলেও এবার সত্যিকারের বিশ্বমঞ্চে হাজির হলেন ফিশার। ম্যাচের আগে আবার উপস্থিত না হওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্ক থেকে রেইকাভিক পৌঁছুতেও দেরি করে ফেলেন। ফিশার নিজেই চেয়েছিলেন টেলিভিশনে খেলা দেখানো হোক। আবার টিভি ক্যামেরার শব্দের অস্বস্তি হচ্ছে, এহেন অভিযোগ করে খেলাই বন্ধ করে দেন এক পর্যায়ে। কৌশলে জট পাকিয়ে স্পাসকির বিরুদ্ধে ২৪ ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতেই হেরে বসেন ফিশার। আক্রান্ত হন প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়ায়। ভাবতে থাকেন, হয়তো তাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করছে রাশিয়ানরা। এরকম মানসিক অবস্থায় দ্বিতীয় ম্যাচ বাতিল করে দেন ফিশার। শোনা যায়, ফিশারকে সিরিজ খেলতে রাজি করানোর জন্য চেষ্টা করেছেন মার্কিন তৎকালীন নিরাপত্তা পরামর্শক হেনরি কিসিঞ্জারও।
অবশেষে বরিস স্পাসকির সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে রাজি হন ফিশার। নতুন এক দাবি তোলেন, বরিস স্পাসকি যদি দর্শকের আড়ালে ছোট কক্ষে খেলতে রাজি না হন, তাহলে টুর্নামেন্ট না খেলেই চলে যাবেন তিনি। সম্পূর্ণ আওয়াজ নিরোধক কক্ষে আয়োজন করতে হবে ম্যাচ। শব্দ যাতে না হয়, সে জন্য দাবার বোর্ডও নতুন করে বানানোর ফরমায়েশ দেন ফিশার। বরিস স্পাসকি এর সবই মেনে নেন। ৩য়, ৪র্থ আর ৫ম ম্যাচ খেলা হয় বদ্ধ ঘরে। দুইটি জয় আর একটি ড্র করেন ফিশার। তাদের দুজনের পয়েন্ট দাঁড়ায় সমান সমান: ২.৫-২.৫।
এরপর ফিরে আসে ফিশারের আত্মবিশ্বাস। ৬ষ্ঠ ম্যাচের খেলাও ফিরে আসে হলরুমে। আবারও সারাবিশ্বের চোখ খুঁজে পেলো ফিশার-স্পাসকির ম্যাচ। হাই ভোল্টেজ এই ম্যাচ নিয়ে বোদ্ধাদের ধারণা ছিল, এই ম্যাচ যে জিতবে তারই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বেশি। দাবার মোড়কে নাটকীয় মোড় নেয় সোভিয়েত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধ।
এই ম্যাচের ববি ফিশারের মাস্টারস্ট্রোকের দেখা পাওয়া যায় প্রথম থেকেই। ফিশার খেলা ওপেন করেন সম্পূর্ণ অপ্রচলিত ভঙ্গিতে; যেভাবে তিনি আগে কখনোই খেলা শুরু করেননি। শুরুতেই চমকে যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পাসকি। তবে সেই বিভ্রান্ত ভাব কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে খেলতে থাকেন স্পাসকি। ফিশারের নিখুঁত খেলার সামনে ম্যাচের ২১ তম চালে ছোট একটি ভুল করতে বাধ্য হোন স্পাসকি। এরপর ফিশার ধীরে ধীরে স্পাসকিকে কোণঠাসা করে ফেলেন। কোনোভাবেই আর কোনো পথ না দেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান স্পাসকি। করতালি দিয়ে স্বাগত জানান ফিশারকে। তার সাথে সাথে করতালি দিতে থাকে দর্শকেরা। পরাজিত গ্র্যান্ডমাস্টার বিজয়ী গ্র্যান্ডমাস্টারকে হেরে যাওয়ার পর করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করছেন, এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ৩.৫-২.৫ ব্যবধানে ববি এবার লিড নিলেন টুর্নামেন্টে। ৬ নম্বর গেমটিকে বলা হয় ‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’।
প্রথমবারের মতো লিড নেয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি ফিশারকে। সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোর মধ্যে আর কেবল একটিতেই তিনি হেরেছিলেন স্পাসকির কাছে। ২১ ম্যাচ শেষে ১২.৫-৮.৫ পয়েন্টে বিজয়ী হোন ববি ফিশার। বছরের পুরো জুলাই আর আগস্ট মাসের বেশিরভাগ সময় বিশ্বের নজর আটকে ছিল এই দুই দাবাড়ুর যুদ্ধে। রেইকাভিকে যখন শেষ হলো বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ, ততদিনে জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন ববি ফিশার। কারণ, বিশ্ব জেনে গেছে তিনি এমন একজন, যিনি রাশিয়ানদের হারাতে পারেন রাশিয়ানদের খেলায়।
ববি ফিশার বরাবরই ছিলেন বিদ্রোহী। দাবার বোর্ডে তার ট্রেডমার্ক ছিল বুনো আগ্রাসন। ফিশারের ক্যারিশমায় প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দাবা পেলো ভিন্নমাত্রার মর্যাদা। স্পাসকি যখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, তখন তার প্রাইজমানি ছিল ১ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। আর ‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’র পর বিজয়ী ববি ফিশার প্রাইজমানি হিসেবে পান আড়াই লাখ ডলার। রেইকাভিকে ফিশার-স্পাসকির ম্যাচের প্রতিবেদনের দায়িত্বে ছিলেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক হ্যারল্ড শনবার্গ। তিনি ১৯৭৩ সালে তার বই ‘গ্র্যান্ডমাস্টার্স অব চেজ’-এ লিখেছেন, ববি ফিশার সম্পূর্ণ একা হাতে সারা বিশ্বকে দেখিয়েছে যে, দাবার সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলা হতে পারে ফুটবলের মতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের মতো, শিল্পের মতো নান্দনিক; মানবিক চিন্তাধারার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধ্যান যেখানে প্রয়োজন পড়ে।
১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশনের নিয়ম মেনে আনাতোলি কারপভের সঙ্গে খেলতে অপারগতা প্রকাশ করেন ববি ফিশার। কেড়ে নেয়া হয় তার টাইটেল। ফিশারের জীবনে পতনের শুরু সেই থেকে। ওয়ার্ল্ডওয়াইড চার্চের সদস্যদের বিরুদ্ধে এক মামলায় হেরে গিয়ে দেউলিয়া ও গৃহহীনও হয়ে পড়েন এই রহস্যময় তারকা।
নিজেকে ধীরে ধীরে দাবা থেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিতে থাকেন ববি ফিশার। শোনা যায়, নিজের আগের খেলাগুলোই চর্চা আর বই পড়ে নাকি সময় কাটাতেন তিনি। এরইমধ্যে, ১৯৯২ সালে ‘গেম অব দ্য সেঞ্চুরি’র দুই দশক পূর্তিতে বরিস স্পাসকির সাথে আরেকটি ম্যাচ খেলেন ফিশার। ৫ মিলিয়ন ডলারের সেই ম্যাচও অনায়াসেই জিতে নেন ফিশার। ধারণা করা হয়, অর্থের জন্যই কেবল ম্যাচটি খেলতে রাজি হয়েছিলেন ফিশার।
মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের একটি সতর্কতামূলক চিঠি নিয়ে ফিশার এসেছিলেন এই ম্যাচের সংবাদ সম্মেলনে। বসনিয়ায় যুদ্ধ চালানোয় যুগোস্লাভিয়ার ওপর তখন ছিল মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। সেখানে দাবা খেলে সেই নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন ফিশার। চিঠিতে ম্যাচটিকে একটি ‘অর্থনৈতিক প্রকল্প’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, ম্যাচটি খেললে জরিমানা ও গ্রেফতারের মুখোমুখি হবেন ফিশার। প্রায় দেড়শর বেশি সাংবাদিকের সামনে ওই চিঠিতে থুতু দিয়ে ছুঁড়ে মারেন এই দাবা বিস্ময়।
চেজ শিক্ষক ও লেখক ব্রুস প্যান্ডলফিনি বলেছিলেন, ববি ফিশার যদি প্রকৃতিস্থ হিসেবেই জীবনটা কাটাতেন, তবে আমরা পেতে পারতাম শতশত মাস্টারপিস পারফরমেন্স। তার গুরুত্ব যেমন আমরা অনুভব করি, তেমনি করেন প্রতিটা দাবা খেলোয়াড়।
সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, চেজ ডটকম, বিবিসি।
গ্রন্থনা: মন্জুরুল ইকরাম
/এম ই
Leave a reply