আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যাকাণ্ড: মুসার জবানবন্দিতে যা জানা গেলো

|

মনিরুল ইসলাম:

মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার আগে দু’টি রেস্টুরেন্টে বৈঠক করে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়ক সুমন শিকদার ওরফে মুসার আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এ তথ্য।

তিনি এও জানিয়েছেন, দুবাই থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিক নির্দেশ দেন। দেশের ভেতরে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। আর সবকিছুর নেপথ্যে কাজ করেছে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাত দখল, ডিশ ব্যবসা ও আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব। যমুনা নিউজের কাছে মুসার জবানবন্দির কপি এসেছে। আর তাতে এসব তথ্য জানা যায়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলির এখনও বিশ্বাস হয় না, তার স্বামী জাহিদুল ইসলাম টিপু তারই রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের হাতে খুন হয়েছেন! এ খুনের ঘটনায় মামলা করেন টিপুর স্ত্রী ডলি।

জানা গেছে, তদন্তে প্রভাবশালী আসামিদের নাম যাতে না আসে সেজন্য মামলা দায়েরের পর থেকেই হুমকি পাচ্ছেন ডলি।

ফারহানা ইসলাম ডলি জানান, ইতোমধ্যে ৫টা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। প্রথমে বিদেশ থেকে ফোন আসতো। তারা বলতো নাম বাদ দিতে; আমি বলতাম, সাধারণ এজাহার করেছি, কী বাদ দিবো? তখন তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিতো। যে চারটা নাম বলা হতো- গোলাম আশরাফ তালুকদার, মারুফ আহমেদ মনসুর, সোহেল শাহরিয়ার আর সাগর।

যাদের নাম বাদ দিতে টিপুর স্ত্রীর কাছে হুমকি আসতো, তারাই এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে, সেটির সূত্র মিলেছে অন্যতম আসামির জবানবন্দিতে।

টিপু হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে কিলিং মিশন সমন্বয় করেন মতিঝিল এলাকার সন্ত্রাসী সুমন শিকাদর ওরফে মুসা। খুনের কয়েকদিন আগে পালিয়েছিলেন বিদেশে। পরে ওমান থেকে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে ডিবি পুলিশ। টিপু হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন মুসা।

তার দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী, হত্যার পরিকল্পনা করতে দুই দফায় বৈঠক হয়। প্রথমটি গত বছরের ১৫ জানুয়ারি, পল্টনের একটি রেঁস্তোরায়। সেখানে মুসাকে ডেকে নিয়ে যান টিটু নামের এক ব্যক্তি। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ ওরফে মনসুর, মতিঝিল ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ার, ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মারুফ রেজা ওরফে সাগরসহ আরও ১০-১২ জন। ভিডিও কনফারেন্সে তাদের সাথে যুক্ত হন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও মানিক। মূলত, ঠিকাদারি ব্যবসা, ডিশ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, ফুটপাত নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধান্ত হয় টিপুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার। এ জন্য ৫ জনকে নির্দেশ দেয়া হয় টাকা সংগ্রহের।

হত্যা পরিকল্পনার দ্বিতীয় বৈঠক হয় বেইলি রোডের একটি রেঁস্তোরায়। সেখানেও আগের বৈঠকের সবাই উপস্থিত ছিলেন। ভিডিও কলে যুক্ত ছিলেন জিসান-মানিক। কিলিং মিশনে খরচের জন্য কাকে কতো দেয়া হবে তা ঠিক হয় ওই বৈঠকেই।

মুসার স্বীকারোক্তি মতে, আশরাফ তালকুদার তাকে বলেন, খুনের জন্য যা করার করো, জিসান ও মানিক সব সহায়তা করবে। নিজের এলাকায় নয়, হত্যা করতে হবে পাশের ওয়ার্ড এলাকায়। কয়েকজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়, এলাকায় রেকি করতে। মুসার মাধ্যমে মোল্লা শামীমকে অস্ত্র ও বাইক ভাড়ার জন্য দেয়া হয় দুই লাখ টাকা।

আদালতে জবানবন্দিতে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করেন মুসা। যারা কিনা পরিকল্পনা, নির্দেশ, সরাসরি খুন ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছেন। তদন্তকারীরা বলছেন, এদের বাইরে আরও বেশ কজন আছেন, যারা হত্যায় জড়িত। এখন পর্যন্ত এ খুনের ঘটনায় ২৫জনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ।

ডিএমপি (মতিঝিল বিভাগ) ডিবির উপ-কমিশনার রাজীব আল মাসুদ জানান, মামলার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যাবে, এ রকম কোনো কিছুর সম্মুখীন আমরা এখনও হইনি। আমরা বেশ কজনের নাম পেয়েছি, তদন্ত শেষ পর্যায়ে। কিছু ছোটখাটো ব্যাপার আছে, যা আমাদের একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেগুলো নিয়েই আমরা কাজ করছি এখন। দ্রুতই এ মামলার চার্জশিট দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে কিছুটা আক্ষেপ করেছেন সুমন শিকদার মুসা। বিচারকের কাছে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর সবাই এখন সুবিধা ভোগ করছেন আর তিনি ফেঁসে গেছেন। মুসার জবানবন্দির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বলে দাবি টিপুর পরিবারের। মাস্টারমাইন্ডদের ৪-৫ জন এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মামলার বাদি ফারহানা ডলি।

/এসএইচ/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply