সাদ্দাম পরবর্তী দুই দশক, ইরাক পরিণত হয়েছে ব্যর্থ রাষ্ট্রে

|

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ছবি।

ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতনের দু’দশক পার হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শান্তি-স্থিতিশীলতা ফেরানোর যে আশা দেখেছিল ইরাকের মানুষ; সাদ্দামহীন ইরাকে তা বাস্তবায়ন তো হয়নি, বরং আরও খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। গত ২০ বছরে জঙ্গিবাদ, অভ্যন্তরীণ সহিংসতা আর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে ইরাক। প্রাণ গেছে ৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের।

ছেলের ব্যবহার করা পুরোনো জিনিসপত্র স্পর্শ করেই যেন সন্তানকে অনুভব করতে চান আইএসের হামলায় নিহত এক ইরাকি বিমান কর্মকর্তার বৃদ্ধ বাবা মাজিদ মোহাম্মদ । ২০১৫ সালে ক্যাম্প স্পেইসারে ১৭শ’ ইরাকি বিমান সেনাকে হত্যা করে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। নিহতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, মাজিদ মোহাম্মদের একমাত্র ছেলে।

সম্প্রতি দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মাজিদ মোহাম্মদ বলেন, একদিন সকালে আমার ছেলের ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে জানানো হলো জঙ্গিদের হামলায় সে মারা গেছে। এখন তার ছবি আর এসব স্মৃতিই আমার সম্বল। এসব নিয়েই বেঁচে আছি।

ইরাকে অস্থিতিশীলতার আরেক শিকার, ইখলাস তালাল। অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে স্বামী নিখোঁজ এ নারীর। ইরাকি সামরিক বাহিনীর সদস্য ইখলাস বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন সেটিও জানেন না তিনি কিংবা কেউই।

নিখোঁজ এক ইরাকি সেনা সদস্যের স্ত্রী ইখলাস তালালের জিজ্ঞাসা, একে কি বেঁচে থাকা বলে? জানি না, আমার স্বামী জীবিত আছেন না মারা গেছেন। কর্তৃপক্ষ শুধু তার কিছু নথিপত্র আমাকে ধরিয়ে দিয়েছে। গত ৮ বছর ধরে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি।

ইরাকজুড়ে অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা আর অনিশ্চয়তার এ চিত্র গত দু’দশক ধরে পরিণত হয়েছে নিয়মিত ও স্বাভাবিক দৃশ্যে। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে অভিযান শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী। ওই বছর ডিসেম্বরে আটক হন সাদ্দাম হোসেন। তার ঠিক ২ বছর পর কার্যকর হয় তার ফাঁসি। দেশটিতে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই অভিযান হলেও গত ২০ বছরে দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। সাদ্দাম শাসনামলের চেয়ে সহিংসতা-অস্থিতিশীলতা তো কমেইনি বরং বেড়েছে। মার্কিন অভিযানের পর যুদ্ধে প্রাণ গেছে ২ লাখের বেশি ইরাকির।

২০০৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে জুতা মেরে বিশ্বব্যাপী আলোচিত ইরাকি সাংবাদিক আল জায়েদি তার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরাকের আজকের এ পরিণতির জন্য আমেরিকা ও প্রেসিডেন্ট বুশই দায়ী। আমি এ কারণেই তাকে জুতা মেরেছিলাম। এ কাজের জন্য আমি মোটেও অনুতপ্ত নই।

শুধু তাই নয়, ইরাককে ভিত্তি করে জন্ম হয় নৃশংস আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এর। যারা নির্মমভাবে হত্যা করে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার বেসামরিক মানুষকে।

সাদ্দামহীন ইরাকে চরম আকার ধারণ করে অর্থনৈতিক সংকট। গোষ্ঠীগত দাঙ্গা-সহিংসতা পরিণত হয় নিয়মিত ঘটনায়। যুদ্ধ-সংঘাতে উদ্বাস্তু হন লাখ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় ইরাক। এ দীর্ঘ সময়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে ইরাকে অভিযানের অজুহাত হিসেবে দেখানো সাদ্দাম হোসেনের কাছে থাকা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিষয়টি।

সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা লুইস রুয়েদা জানান, অস্ত্রের বিষয়টি ছিলো অজুহাত মাত্র। যেকোনোভাবেই হোক, ইরাকে হামলা করতোই মার্কিন-ব্রিটিশ জোট।

সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা লুইস রুয়েদা বলেন, সাদ্দামকে উৎখাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র কোনো মুখ্য বিষয় ছিল না। কিছু থাকুক আর না থাকুক ইরাকে অভিযান হতোই। শুধু গণবিধ্বংসী অস্ত্র নয়, সাদ্দামের কাছে রাবার ব্যান্ড কিংবা পেপার ক্লিপ থাকলেও ইরাকে হামলা হতো।

প্রসঙ্গত, সাদ্দামের পতনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন ও মুক্তভাবে বাঁচার যে স্বপ্ন ইরাকিরা দেখেছিলো তা গত দু’দশকে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। চলমান সহিংসতা কবে বন্ধ হয়ে স্থিতিশীলতা ফিরবে তা জানা নেই কারোরই।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply