নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ:
‘আমি রোজা আছি আমাকে তোরা মারিস না ইফতারটা করতে দে তারপর মারিস’। মৃত্যুর আগে এভাবে জীবনের জন্য আকুতি জানান শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী জেম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন।
বুধবার (১৯ এপ্রিল) শহরের উদয়ন মোড় এলাকায় প্রকাশ্য জনসম্মুখে জেমকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত ১০ দিনে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে এবং ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা তালিকায় আরও ১০ জনের নাম শোনা যাচ্ছে অথচ পুলিশ নির্বিকার এমনটাই অভিযোগ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ এপ্রিল বালু উত্তোলনের বিরোধকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের কালিনগর বাবলাবোনা গ্রামের খান মোহাম্মদ গুদোড়ের ছেলে মনিরুল ইসলাম নামে একজনকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সাইকেলে করে ফেরার পথে নিজ বাড়ি থেকে মাত্র ৪’শ গজ দূরে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করা হয়।
১৩ এপ্রিল শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আলম আলী ঝাপড়া বাইসাইকেল যোগে বাড়ি ফিরছিলেন। নবাব মোড় এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রকাশ্যে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সবশেষ ১৯ এপ্রিল হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সাবেক যুবলীগ নেতা খায়রুল ইসলাম জেম।
জেম হত্যাকাণ্ডের অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী ও পৌর যুবলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মামুন অর রশিদ জানান, বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমি উদয়ন মোড়ে ইফতারি কিনে বাসায় ফিরছিলাম। এ সময় উসকাঠিপাড়া মসজিদের সামনে হঠাৎ চিৎকার শুনে পেছনে ফিরে দেখি টুটুল, রানা, ইব্রাহিম ও শামিম জেম ভাইকে এলোপাথাড়ি কোপ দিচ্ছে। এছাড়া আরও কয়েকজন আশেপাশে ছিল। আমি জেম ভাইকে বাঁচাতে গেলে তারা আমাকে অস্ত্র নিয়ে ঘিরে ধরে রাখে এবং আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। পরে ওরা পালিয়ে গেলে জেম ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্তু আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি।
এ ঘটনায় ২০ এপ্রিল সারাদিন শহরজুড়ে চলে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ। এর আগে রাতে ঘেরাও করা হয় সদর থানা, ভাঙচুর করা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর ভবন।
বৃহস্পতিবার যুবলীগ নেতা খায়রুল আলম জেম হত্যায় জড়িত মূল পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে লাশ নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। দুপুর দেড়টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কের শান্তিমোড়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। জেমকে বহনকারী লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স সড়কে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। অবরোধ চলাকালে নেতা-কর্মীরা জেম হত্যার পরিকল্পনাকারী ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।
এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর-৩ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ। তিনি বলেন, আলম ঝাপড়া মার্ডার ও মর্দনা গ্রামের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা নিয়ে গেল ১৫ এপ্রিল জেম ফেসবুকে লাইভে এসে ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলামে বিষয়ে অনেক কথা ফাঁস করে দেয়। এছাড়া ডিআইজি’র গ্রামের বাড়ির একটি দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এসব ঘটনার জেরে সন্ত্রাসী টুটুল বাহিনীকে দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ডিআইজি নুরুল ইসলাম পৌর মেয়র মুখলেসুর রহমানকে ব্যবহার করে এসব অপকর্ম করছেন। আমরা জানতে পেরেছি মেয়র মুখলেস আমাদের ১০ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই জেম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এখানকার এসপি অত্যন্ত দুর্বল মানসিকতার লোক তার এই দুর্বলতা ও ডিআইজি নুরুল প্রীতির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে। ডিআইজি নুরুল ইসলাম এলাকার কিশোর গ্যাং দিয়ে পৌর মেয়র মুখলেসুর রহমানের মাধ্যমে এসব অপকর্ম ও হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন বলে এমপি ওদুদ দাবি করেন।
ডিআইজি নুরুল ইসলাম, মেয়র মুখলেসুর রহমান ও সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী লিটন জড়িত বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে পরপর তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু পুলিশ এখন নিশ্চুপ হয়ে আছে। জেমের প্রকৃত হত্যাকারী ও তাদের গডফাদারদের দ্রুত গ্রেফতার করা না হলে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ারি জানান আওয়ামী লীগের এই এমপি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশের মুখপাত্র এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ জানান, কতিপয় দুর্বৃত্ত অতর্কিত হামলা চালিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। অপরাধীদের ধরতে আমাদের অভিযান চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১২ থেকে ১৫ জনকে নিয়ে এসেছি। এখনও এজাহার পাইনি, এজাহার পেলে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পৌর মেয়র মুখলেসুর রহমান, এমপি সাহেব আমার পোস্টার দেখে এসব অভিযোগ করেছেন। আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই পোস্টার দেখেই তিনি এখন আমাকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে অনেকের সাথে আমাকে চলতে হয়, সে হিসেবেই চলি। টুটুলের বিরুদ্ধে তো এর আগেও হত্যা মামলা আছে। তখন তো আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিল না। এখন তাহলে আমার ওপর দায় আসবে কেন?
১০ জন্যকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আমার জানা নেই। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। প্রতিহিংসার কারণে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে।
ডিআইজি নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য যেসব অভিযোগ করছেন সেসবের প্রমাণ তিনি দিক, তিনি প্রমাণ করুক। আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। অথচ আমার বিরুদ্ধে তিনি ব্লেম করছেন। আমার ইশারায় নাকি মানুষ তাকে ভোট দিচ্ছে না। এ ধরনের অভিযোগও তিনি করেছেন। আসলে ভালো কাজ করলে তার সহ্য হয় না। তাই তিনি এসব অভিযোগ করছেন। আর আমি গত দুই বছর বাড়ি যাইনি। বাবা মা’র কবর জিয়ারত করতে যেতে পারিনি। তাহলে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে কীভাবে? আমি তো রাজনীতি করি না সুতরাং এলাকার রাজনীতি নিয়ে আমার কোনো হেডেক নেই। তবে এলাকার অনেকে আমার কাছে দেখা করতে আসে, এটুকুই। আমি কারও কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করি না। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করছে, সে অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রসঙ্গত, বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে ইফতার কিনে বাড়ি ফেরার পথে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা খাইরুল আলম জেম। এ ঘটনায় থানায় এখন পর্যন্ত মামলা দায়ের না হলেও সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকের দাবি করেছে পুলিশ।
/এনএএস
Leave a reply