“অনেক দশক পাওয়া যাবে যখন কিছুই ঘটে না। আবার কোনো কোনো সপ্তাহে ঘটে যায় দশকের ঘটনা।”- ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বিখ্যাত এই কথাকে তামিম ইকবালের সাথে মিলিয়ে দেখুন। সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি, বোর্ড প্রেসিডেন্টের করা প্রকাশ্য সমালোচনা, রহস্যময় সংবাদ সম্মেলন আয়োজন, সেখানে চোখের জলে ক্রিকেটকে বিদায়। ভক্ত-সমর্থকদের আহাজারি। ২৪ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ। তারপর অবসর ভেঙে তামিম ইকবালের ফিরে আসার ঘোষণা। এখানে এক সপ্তাহও যায়নি। ৪-৭ জুলাই, মোটে ৪ দিন। কিন্তু নাটকীয়তার বিচারে যেন তামিমের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে এক দশকের ঘটনা!
ঘটনার শুরু গত ৪ জুলাই। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে তামিম বলেন, তিনি পুরোপুরি ফিট নন। তবে প্রথম ম্যাচ খেলবেন। শারীরিক অবস্থা কেমন তা খেলার পরেই বুঝতে পারবেন। এ কথার পর চারিদিকে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। গণমাধ্যমের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। জানা গেছে, এ ইস্যুতে খুশি ছিলেন না বাংলাদেশ দলের কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে! বোর্ড সভাপতির প্রকাশ্য সমালোচনা তামিমের অবসরের সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছিল কিনা তা জানা যায়নি। অবসরের ঘোষণার কারণ সম্পর্কে এখনও কিছু বলেননি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটার।
৬ তারিখ দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকেন তামিম ইকবাল। সেটি পিছিয়েও যায় ঘণ্টা দেড়েক। চট্টগ্রামের একটি হোটেলে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলন চলে মাত্র ১৩ মিনিট। অবশ্য, সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিজের স্বগতোক্তির মাঝে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই ব্যাটার। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে তামিম ইকবাল বলেন, আফগানিস্তানের সাথে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেই ছিল আমার সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। আমার আজ সত্যিকার অর্থে বেশি কিছু বলার নেই। একটি কথা আমি অবশ্যই বলবো, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়েই চেষ্টা করেছি। হয়তো আমি যথেষ্ট ভালো করতে পারিনি। তবে, যখনই মাঠে থেকেছি, আমার শতভাগ দেয়ার চেষ্টাই করেছি। আমার চ্যাপ্টার এখানেই শেষ করে দিন, অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ক্ষেত্রে। এটা নিয়ে আর টানাহেঁচড়া করার দরকার নেই যে, কেন এই সিদ্ধান্ত। এটা এখানেই শেষ। এটাই ‘দ্য এন্ড’।
এরপর তামিম হয়ে গেলেন টক অব দ্য টাউন। তার এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠলো আলোচনার ঝড়। বিশ্বকাপের মাত্র তিন মাস আগে জাতীয় দলের অধিনায়কের আকস্মিক অবসরের ঘটনা বিশ্বকাপ পরিকল্পনার জন্যও হয়ে আসে বড় এক আঘাত। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সে রাতেই গণমাধ্যমে জানান, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার ব্যাপারে তামিমকে অনুরোধ করেছেন তিনি। তবে এক আকস্মিক সিদ্ধান্তে নিজের অসন্তুষ্টি লুকিয়ে রাখেননি বোর্ড সভাপতি।
অন্যদিকে, আহাজারি-হাহাকার শুরু হলো ভক্ত- সমর্থকদের। তামিমের সিদ্ধান্ত বদলের দাবিতে চট্টগ্রামে হয়েছে মানববন্ধন। ভক্তরা সেখানে ব্যানারে লিখে, ‘অভিমান ভেঙ্গে ফিরে আসুন খান সাহেব, বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখিয়ে এভাবে চলে যেতে পারেন না।’ তামিমের ফেরার দাবিতে র্যালিও হয়েছে। সেখানে ‘তামিম তামিম’ স্লোগানের সাথে দাবি জানানো হয়, তাকে জাতীয় দলে দেখতে চাই, বিশ্বকাপে দেখতে চাই।
এসব দাবির প্রেক্ষিতে তামিম ইকবাল কী করতেন সে আলোচনার সুযোগ নেই। কারণ, অবসর নেয়ার একদিনের মধ্যেই তামিম আবার ক্রিকেটে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন খান সাহেব। এর মাঝেই অবসর ঘোষণার রাতে গুঞ্জন ওঠে, তামিমকে ডিনারে ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে তামিমের ঘনিষ্ঠ সূত্রে বিষয়টি গুজব বলে জানা যায়। তবে তার ১২ ঘণ্টা পার না হতেই জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যান তামিম। প্রায় তিন ঘণ্টা পর প্রধানমন্ত্রীর বাসা থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমকে তামিম জানান, তিনি অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আগের দিন হুট করেই জাতীয় দলের ‘সাবেক’ ক্রিকেট হয়ে যাওয়া তামিম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ আমাকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ করেছিলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ক্রিকেটে ফেরার। আমি আমার অবসরের সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নিচ্ছি।
তামিম বলেন, আমি সবাইকে ‘না’ বলতে পারি কিন্তু, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নয়। তাতে অবশ্যই মাশরাফী ভাই ও পাপন (নাজমুল হাসান) ভাইয়ের বড় ভূমিকা ছিল। মাশরাফী ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে গেছেন। পাপন ভাই সাথে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেড় মাসের ছুটিও দিয়েছেন। যাতে আমি চাঙা হয়ে ফিরতে পারি।
বিসিবি সভাপতি বলেছেন, ওর প্রেস কনফারেন্স দেখেই বুঝেছি, এটা আবেগ থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত। জানতাম, যদি সামনাসামনি বসতে পারি তবে একটা সমাধান বের করে ফেলতে পারবো। আজ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তামিম অবসর নিচ্ছে না। সে ছয় সপ্তাহের বিশ্রামে যাচ্ছে। পুনর্বাসন শেষে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙা হয়ে সে ক্রিকেটে ফিরবে।
আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজে খেলবেন না তামিম। লিটন দাস এই সিরিজে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। তামিমের ঝড়ে দলের মনোযোগ সরে গিয়েছে কিনা তা দেখা যাবে আগামীকালের (৮ জুলাই) ম্যাচে, যেখানে সিরিজ বাঁচাতে জিততেই হবে হাথুরুসিংহের শিষ্যদের। দেশবাসীর আলোচনায় এই সিরিজের আলাপ স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চাপা পড়েছে। ঘুরে-ফিরে আসছেন তামিম ইকবাল। অবসর ভেঙে ফিরে এসে দলকে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ফেলেছেন বলে বাংলাদেশের বাঁহাতি ব্যাটারের সাথে হালকা আমেজে টেনে নিয়ে আসা হচ্ছে আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসিকে। ভারসাম্যপূর্ণ স্কোয়াড নিয়ে বিশ্বকাপে যাওয়া সাকিব-তামিমদের কেন্দ্র করে বড় আশাই করছে সমর্থকরা। মেসির পদাঙ্ক যদি তামিম শেষ ধাপ পর্যন্ত অতিক্রম করেই ফেলেন তাহলে লেনিনের কথা অনুসরণ করে বলা যায়, চারদিনে পূর্ণ তামিম-চক্রে বীজ বপন হয়েছিল সেই ঘটনার, যা অন্তত তিন দশকের জন্য হবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় ঘটনা।
/এম ই
Leave a reply