দিনের খেলা বাকি ২২.১ ওভার। ওভাল টেস্টেরও; এমনকি অ্যাশেজের জন্যও তাই। ঠিক আগের দু’টি বলে সামান্যর জন্য টড মার্ফির ব্যাটের ছোঁয়া খুঁজে পায়নি স্টুয়ার্ট ব্রডের অ্যাঙ্গেল করে বের হয়ে যাওয়া ট্রেডমার্ক আউটসুইঙ্গার। নিজের ক্যারিয়ারের শেষ স্পেল করছেন তখন ব্রড। ২০২৩/২৪ অ্যাশেজে জেমস অ্যান্ডারসন নিজের ছায়া হয়ে থাকায় ইংলিশ বোলিং আক্রমণের নেতৃত্ব নিজ কাঁধে সফলতার সাথে বয়ে বেড়ানো ব্রড তার শেষ ইনিংসে তখনও পাননি কোনো উইকেটের দেখা। অজিদের টেস্ট জিততে দরকার ৫৫ রান। আর ইংল্যান্ডের ২ উইকেট। বাঁহাতি ব্যাটারদের বিপক্ষে রাউন্ড দ্য উইকেটে তখনও পর্যন্ত দারুণ বল করেছেন। পরপর দুই ডেলিভারিতে মার্ফির ‘এজ’ না পেয়ে বোলিং মার্কে ফেরার সময় স্ট্যাম্পের বেল দুইটির জায়গা বদল করে রাখলেন ব্রড। ধারাভাষ্যকার বলে উঠলেন, ‘দ্যাটস ওল্ড বেল ট্রিক!’ বেল পাল্টে ভাগ্য বদল করা গেলে কেন নয়!
প্রায় পুরো ওভালই তখন করতালির মাধ্যমে উৎসাহ জাগিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় ‘ব্রডি’কে; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুণ পারফরমেন্সের কারণে যাকে অনায়াসে ‘সত্যিকারের অ্যাশেজ যোদ্ধা’ বলা যায়, যেমনটি বলেছেন রিকি পন্টিং। রানআপ নিয়ে আসলেন ব্রড। আবারও আগের মতোই রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে প্রায় একই লাইনে ডেলিভারিটি করলেন; তবে আগের দুইটির চেয়ে কিছুটা ফুল লেন্থে। টেল এন্ডার টড মার্ফির জন্য এই বলের জবাব দেয়াটা ছিল একটু বেশিই কঠিন। এবার ‘এজ’ পেলেন ব্রড। বল খুঁজে পেলো জনি বেয়ারস্টোর গ্লাভসের আশ্রয়। ব্রডের ট্রেডমার্ক ‘অ্যারোপ্লেন সেলিব্রেশনের’ সামনে তখন অশান্ত হয়ে উঠেছে পুরো ওভাল! স্টুয়ার্ট ব্রড যে নিজের হাতেই লিখলেন তার বিদায়ী রূপকথা! তা তিনি লিখতেই পারেন। স্নায়ুক্ষয়ী ওভাল টেস্ট যখন শেষ সেশনে উপস্থিত, রান তাড়া আর উইকেট পতনের ক্লাইম্যাক্স যখন চলছে সমান্তরালে; তখন ‘ওল্ড বেল ট্রিক’ কাজে লাগিয়ে ভাগ্যদেবীকে নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে বাধ্য করাটা যে স্টুয়ার্ট ব্রডের পক্ষেই সম্ভব!
দুই ওভার পর আবারও বোলিং মার্কে ব্রড। আর চাই একটি উইকেট। ক্যারিয়ারের শেষ ক’টা বলের মধ্যেই কি পেতে যাচ্ছেন আরাধ্য অমরাবতী? ব্রড চেয়েছিলেন শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট থেকেই বিদায় নিতে। আর তার কাছে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট মানেই মর্যাদার অ্যাশেজ। সিরিজ জয় হচ্ছে না, ম্যানচেস্টার টেস্ট বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়ার পরই যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে জশ হ্যাজলউড এবং স্ট্রাইকে অ্যালেক্স ক্যারি। একটি উইকেট পেলেই সমতায় শেষ হবে সিরিজ, আর ব্রড শেষ করবেন জয় দিয়ে। উইকেট দিয়েও যদি হয় সেটা, তাহলে তো ক্রিকেট রূপকথার বইয়ে যোগ হবে আরেক অধ্যায়। সেটাই হলো ব্রডের ফোর্থ স্ট্যাম্প গুড লেন্থ ডেলিভারিতে। বল পিচ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল ক্যারির ব্যাট থেকে। কিন্তু আউটসুইঙ্গারে ক্যারি করলেন নিক, আর বল জমা পড়লো আবারও বেয়ারস্টোর হাতে। দৌড়ে যখন ১৬ বছরের বোলিং পার্টনার জেমস অ্যান্ডারসনের আলিঙ্গনে ধরা পড়লেন ব্রড, তার এবং ইংল্যান্ডের জয়ে তখন গর্জন করছে ওভাল। টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট, যাতে লেখা হলো ইংলিশদের টেস্ট জয় ও অ্যাশেজ সিরিজ ড্র দিয়ে শেষ করা। ‘দ্যাট ওল্ড বেল ট্রিক’ রূপকথার পাতায় ঢুকে গেলো কি?
এভাবে সব শেষ নাও হতে পারতো। আর সেটাই হতো স্বাভাবিক ব্যাপার। ফাস্ট বোলারদের নিত্য সঙ্গী ইনজুরির অনাহূত আগমনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দল থেকে বাদ পড়েছিলেন টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকার পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড। কিন্তু যেভাবে ১৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারকে সামলেছেন, ঠিক একইভাবে ৩৭ বছরেও সাড়া দিলেন। নিজেকে ভেঙে গড়ার দারুণ এক উদাহরণ এই ব্রড। টিকে থাকার মূলমন্ত্র যদি হয় নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে আবিষ্কার করে চলা, তবে এই কাজে ব্রড অবশ্যই একজন শিল্পী, একজন নিদর্শন। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যুবরাজ সিংয়ের কাছে এক ওভারে ৬ ছক্কা হজম করা ব্রডের এপিটাফ তখনই লিখে ফেলেছিলেন অনেকেই! কিন্তু ব্রড তো খেলেন গ্যালারিকে জাগিয়ে তোলার জন্য, যাকে বলা হয় অ্যাশেজের একজন ‘শো-ম্যান’। তিনি মাথায় ব্যান্ডানা পরেন কোনো এক সংস্কার থেকে। ক্রিকেটার হয়ে মাঠে কৌতুকও করেন। বেল পাল্টে ফেলে ঠিক পরের বলেই উইকেট পেয়ে মুখ ঢেকে বিস্ময় প্রকাশও করেছেন নিজের মতো।
তবে, এত সবকিছুর পরেও পর্দা নেমে গেলে ক্রিকেটের এক দারুণ ধারালো মস্তিষ্ক বয়ে বেড়ান ৬০৪ টেস্ট উইকেটের মালিক স্টুয়ার্ট ব্রড। নটিংহ্যামশায়ার এবং ইংল্যান্ডের সাবেক কোচ পিটার মুরস বলেছিলেন, যাদের কোচিং করিয়েছেন তাদের মধ্যে ব্রডই সেরা ট্যাকটিশিয়ান। তাই, যখন দুই বাঁহাতি ব্যাটার হতাশ করছিল ইংল্যান্ডকে, বেন স্টোকস বল তুলে দেন ব্রডের হাতে। ২০১৫ সালের আগে বাঁহাতি ব্যাটারদের বিরুদ্ধে ৪১.১১ গড়ে ৭১ উইকেট ছিল ব্রডের ঝুলিতে। কিন্তু অনেক ঘাটাঘাটি ও গবেষণার পর ওভার দ্য উইকেট থেকে রাউন্ড দ্য উইকেটে নিজের বোলিং অ্যাঙ্গেলে পরিবর্তন আনেন তিনি। এরপর থেকে ২৪.৮৫ গড়ে বাঁহাতিদের বিরুদ্ধে ব্রডের উইকেট সংখ্যা ১২২!
প্রসঙ্গটি ব্রড ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এটা আমার ব্যক্তিত্বের অংশ। অনুশীলনে আমি কখনোই খুব ভালো নই। সেখানে আমার নিজের কোনো না কোনো লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হয়, যা আমাকে তাতিয়ে তোলে। নতুন স্কিল শেখার ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী। এতেই অনুশীলনে আমি কিছুটা হলেও উৎসাহ পাই।
তার কয়টি বল ব্যাটাররা ডাক করে বা ছেড়ে দিচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান দিয়েও নিজেকে বিচার করেন ব্রড। ২০১৯ অ্যাশেজের সময় তিনি বলেছিলেন, যদি খারাপ বল করেন, ৩০ শতাংশ বলই ব্যাটাররা ছেড়ে দেবে। আর ভালো হলে ১৬/১৭ শতাংশ। টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে ব্রডের শেষ দিনে এই শতাংশ নেমে এসেছিল ৮’এ। এসব পরিসংখ্যান নিয়ে স্টুয়ার্ট ব্রড খুব বেশি মাথা না ঘামালেও নামের পাশে ১৫৩টি অ্যাশেজ উইকেট তাকে খুশি না করে পারেই না! সহসাই কোনো ইংলিশ বোলারের পক্ষে এই রেকর্ড ভেঙে ফেলার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে সেসব নয়, শেষ দুই উইকেটই যে বিশেষ তার কাছে! ব্রড বলেন, ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট পেয়ে অ্যাশেজ টেস্ট জয়ের কথা আমাকে আজীবন আনন্দ দেবে। সময় গড়ালে সব স্বাভাবিক হবে। তবে সেই মুহূর্তে সত্যিই মনে হচ্ছিল আমি যেন আমার মাঝে ছিলাম না! এখনও কিছুটা সেরকমই বোধ হচ্ছে।
‘জানি, আমি বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ বোলার নই’- ওভাল টেস্টের মাঝেই স্টুয়ার্ট ব্রড তার মতো একজন এলিট অ্যাথলেটের জন্য কিছুটা বেমানান এ মন্তব্যই করে বসেন। অবশ্য যার টেস্ট বোলিং গড় ২৭.৬৮, তাকে সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের তালিকায় হয়তো রাখা হবে না। কিন্তু লড়াকু মনোভাব, সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের জন্য তাকে স্মরণ করা হবে। যে সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের নির্মাতা কেবলই ব্রডের ভালোবাসা, টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা। যে ভালোবাসা তাকে নিজেকে পুনরাবিষ্কারে উৎসাহ দেয়। তাতেই ছাইভস্ম থেকে জন্ম নেয় অ্যারোপ্লেন উদযাপন। দুই হাত প্রসারিত করে অ্যাশেজ যোদ্ধা উড়ে যান কিংবদন্তি হয়ে ওভালের আকাশে।
/এম ই
Leave a reply