বদলে গেছে ভাতের স্বাদ, পুষ্টিগুণ নিয়েও প্রশ্ন

|

শফিক ছোটন:

ভাতে আগের সেই স্বাদ আর নেই। প্রশ্ন উঠেছে এর পুষ্টিমান নিয়েও। গবেষণায় দেখা যায়, অটো রাইস মিলে চাল সরু করতে গিয়ে ছাঁটাই ও পলিশারের কারণে পুষ্টি উপাদান চলে যাচ্ছে ভয়ংকর মাত্রায়। চালের সেই অংশ চলে যাচ্ছে রাইস ব্র্যান ওয়েল ও পশুখাদ্য তৈরিতে। এতে ভাতের প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ থাকছে না। ছাঁটাইয়ের ফলে চাল উৎপাদনের হিসাবেও গড়মিল দেখা দিয়েছে।

বাজারে চালের নানা ধরণ থাকলেও চকচকে সরু চালের চাহিদা বেশি। যার বড় অংশই আসে অটোমেটিক রাইস মিল হয়ে।

ষাটের দশকের আগে ঢেঁকি ছাঁটা চাল খেয়েছে মানুষ। এরপর আধুনিক মেশিন অর্থাৎ হলার। এখন ৯০ ভাগ চাল উৎপাদন হয় অটোমেটিক রাইসমিলে। এতে ছেঁটে সরু করা চালের স্বাদ ও পুষ্টিমান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

নওগাঁর একটি অটোরাইস মিলে সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের বাধার মুখে পড়ে যমুনা টেলিভিশনের টিম। পরে অন্য আরেকটি রাইস মিলে ঢুকেই দেখা গেলো ১৬টি স্বয়ংক্রিয় মেশিনে চলছে ধান সিদ্ধ-শুকানো ও চাল ছাঁটাইকরণ। এখানে আছে ৪টি রাবার পলিশার বা সিল্কি মেশিন। লোহা ও পাথরের শেল বসানো আছে ৩ থেকে ৪টিতে। এগুলোকে বলা হয় হোয়াইটনার।

অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে দেখা যায় ভয়ঙ্কর চিত্র। ধান থেকে খোসা ছড়ানোর পর লাল আবরণযুক্ত চাল হোয়াইটনারে ফেলে নির্দিষ্ট মাত্রায় ছেঁটে সাদা ও সরু করা হচ্ছে এসব মিলে। চালকে ঝরঝরে-চকচকে করতে পানি মিশিয়ে রাবার পলিশ দেয়া হচ্ছে।

দেশে ধান চালের বড় মোকাম নওগাঁ, দিনাজপুর, কুষ্টিয়ায়। এসব এলাকায় পলিশ করার জন্য গড়ে উঠেছে সেমি অটো মিল। ধান থেকে নয় বরং এসব মিলে চাল থেকেই উৎপন্ন হচ্ছে চাল।

চালের উপরিভাগের ১৫ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে লোহা-পাথরের শেল ও রাবার পলিশের কারণে। আবরণ তুলে বের করা ব্র্যান বিক্রি করা হয় আলাদাভাবে। সেগুলো দিয়ে তৈরি হয় উচ্চমূল্যের রাইস ব্র্যান অয়েল ও পশুখাদ্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ পলিশে পুষ্টি মান কতোটা বজায় থাকে? ২০২১ সালে এ নিয়ে গবেষণা করে ভয়ঙ্কর তথ্য দিয়েছেন কয়েকজন পুষ্টিবিদ। তারা দেখিয়েছেন, ৫ ভাগ পলিশ করলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পুষ্টিমান নষ্ট হয়। আর ১০ শতাংশ পলিশ করলে আয়রণ, প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদন বের হয়ে যায় অর্ধেকের বেশি।

এ নিয়ে খাদ্য গবেষক ড. আব্দুল আলিম বলেন, মিলাররা এখন চাল প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ পলিশ করে ফেলছেন। পলিশ করে ভেতরের যে চাল আমরা পাচ্ছি, তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এটাতে স্টার্স বেশি থাকে। এ কারণে এই চাল খেলে আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়, ডায়াবেটিস জনিত সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু আমরা যখন ঢেঁকি ছাঁটা চাল খেতাম, তখন সেই চালে পুষ্টিমান বেশি থাকতো। চালের বাইরের অংশেই বেশি পুষ্টি থাকে। পলিশ করার কারণে সেই পুষ্টি চলে যায়।

এই ধরনের চাল খেলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব শরীরে ঘটে বলেও জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ মো. আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। সেই সাথে স্ট্রোক, হাই প্রেসার এমনকি ক্যানসারেরও ঝুঁকি তৈরি হয়। এছাড়া সাদা চালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি হয় না।

হোয়াইটনার ও পলিশার ব্যবহারে ক্ষতির কথা স্বীকার করেন মিল মালিকরাও। মোট চাল উৎপাদনের হিসাবেও গড়মিল দেখা দেয় বলে জানান তারা। বিষয়টি নিয়ে নওগাঁর ধান চাউল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন জানান, আমাদের দেশে দুটি মৌসুম মিলে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়। প্রতি মেট্রিক টন ধানে যদি ১৫ থেকে ২০ কেজি চাল কম উৎপাদন হয়, তাহলে গড়ে কত চাল কম হয়!

তবে এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কখনও কোনো বাধা আসেনি উল্লেখ করে অটো রাইসমিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, সরকার আমাদের বাধা দিয়েছে এমনটা কখনও শোনা যায়নি। চালের উপরের লেয়ার কাটা যাবে না বা হোয়াইটনার করা যাবে না এমন নির্দেশও কখনও আসেনি।

এদিকে, কতটুকু চাল ছাঁটাই করা যাবে তা নির্ধারণ করে সরকার নীতিমালা করবে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, নীতিমালা উপেক্ষা করে চাল বেশি ছাঁটাই করলে মেশিন বন্ধ করে দেয়ার বিধান করা হচ্ছে। এটি গ্যাজেট হয়ে আসবে হয়তো ৫-৭ দিনের মধ্যে। আর এই আইনের আওতায় বিধিমালা আমরা প্রস্তুত করে ফেলবো কয়েক মাসের মধ্যে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ভোক্তারা।

এসজেড/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply