আত্মপ্রশংসা ও অন্যদলের সমালোচনায় সংসদে এক-তৃতীয়াংশ সময় ব্যয়: টিআইবি

|

একাদশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় সংসদ সদস্যরা এক-তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করেছেন আত্মপ্রশংসা এবং অন্যদলের সমালোচনা করে। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্নকারীদের প্রায় অর্ধেকই প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য পাওয়া সময়ের ৮০ শতাংশ ব্যয় করেছেন প্রধানমন্ত্রীর ও দলের প্রশংসা এবং অন্য দলের সমালোচনায়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। রোববার (১ অক্টোবর) ‘পার্লামেন্টওয়াচ: একাদশ জাতীয় সংসদ-১ম হতে ২২তম অধিবেশন (জানুয়ারি ২০১৯-এপ্রিল ২০২৩)’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষ্যে টিআইবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংস্থাটি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রকৃত বিরোধী দল না থাকা এবং প্রধান বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাবে জনগনের প্রত্যাশা পূরণেও ঘাটতি রয়ে গেছে।

সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন জোটভুক্ত দল হিসেবে সংসদীয় কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দল দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছে। সংসদকে কার্যকর করে তুলতে বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকা পালনে ঘাটতি ছিল। সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে প্রধান বিরোধীদলের অবস্থান ছিল প্রান্তিক। সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ।

আরও বলা হয়, সংসদীয় কার্যক্রমে বিষয়ভিত্তিক, প্রাসঙ্গিক ও গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে সরকার, দলীয় অর্জন, প্রশংসা ও প্রতিপক্ষ দলের প্রতি আক্রমণাত্মক সমালোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদে বিভিন্ন কার্যক্রমে ৭৪৪ ঘণ্টা ১৩ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা কার্যক্রমে মোট সময়ের ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা মোট সময়ের ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ, বাজেট আলোচনায় ১৯ দশমকি ২ শতাংশ, আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিশেষ কার্যক্রমে ১ দশমিক ২ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে।

এর মধ্যে, রাষ্ট্রপতির ভাষণে প্রায় চার-পঞ্চমাংশ সময় সরকারের অর্জনবিষয়ক আলোচনাই প্রাধান্য পেয়েছে। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব আলোচনায় সরকারদলীয় সদস্যরা সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করেছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা এবং সরকারের অর্জনের প্রশংসায়।

আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, দলের প্রশংসা, অন্য দলের সমালোচনায় মোট সময়ের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় করেছেন। মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রশ্নকর্তা প্রশ্নের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা, দলের প্রশংসা, অন্য দলের সমালোচনা করে ৬৫ শতাংশ সময় ব্যয় করেন। অন্যদিকে উত্তর প্রদানে প্রায় ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায়। সাধারণ আলোচনায় এককভাবে বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট আলোচনাতেই প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি সময় ব্যয় হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করতে গিয়ে সদস্যরা আত্মপ্রশংসা ও অন্যদলের সমালোচনায় ব্যয় করেছেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময়।

গবেষণায় উঠে আসে, কোরাম সংকটে ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট ব্যয় হয়েছে। যা সংসদ কার্যক্রমের মোট ব্যয় হওয়া সময়ের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১৪ মিনিট ৮ সেকেন্ড ব্যয় হয়। সংসদ পরিচালনার প্রতি মিনিটের গড় অর্থমূল্য প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৪ টাকা হিসেব করলে কোরাম সংকটে ব্যয়িত সময়ের অর্থমূল্য ৮৯ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৭৭৯ টাকা।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদের মূল ভূমিকা আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও জনগণের পক্ষে সরকারের জবাদিহিতা নিশ্চিত করা। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকলেও বাস্তবে ব্যাপক ঘাটতি উঠে এসেছে গবেষণায়। একাদশ জাতীয় সংসদে একটি আইন পাশ হতে আন্তর্জাতিক চর্চার অনেক কম সময় লেগেছে। আইন প্রণয়নে কম সময় দেয়ার অর্থ হচ্ছে চুলচেরা বিশ্লেষণে ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে আইন কতোটুকু জনকল্যাণমুখী হলো, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের রূপান্তর যার প্রকট উদাহরণ।

তিনি আরও বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রমে ব্যাপক দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। সংসদ কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে একটি বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কমিটিগুলো তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশ্নোত্তর ও বাজেট আলোচনার বিষয়বস্তুর বাইরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সরকারি সাফল্য ও প্রশংসা এবং প্রতিপক্ষের সমালোচনায় সংসদের সময় ব্যয় হয়েছে। কিন্তু জবাবদিহিতার উপাদান অনুপস্থিত থেকেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা হলেও এ বিষয়ে জবাবদিহিতা বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন নিয়ে জনমনে উদ্বেগ রয়েছে। কার্যকর সংসদ ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃখলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সবাইকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

এ সময় জাতীয় সংসদের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন নিশ্চিতে ১৩টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সংসদ নির্বাচন বাস্তবিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা ও বিরোধী দলের শক্তিশালী ভূমিকা পালন নিশ্চিত করা; সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা; সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে বিরোধী দলের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া; সংসদ সদস্যদের আচরণ ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা অনুসারে ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়ন করা; সংসদে শৃঙ্খলা রক্ষাসহ অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের জোরালো ভূমিকা নেয়া; অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা, অহেতুক প্রশংসা ও সমালোচনা না করে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং ফলপ্রসূ আলোচনা নিশ্চিতে দলীয় প্রধান ও হুইপের জোরালো ভূমিকা পালন করা।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। টিআইবির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা ও মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন।

/এনকে/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply