এ চিঠি উড়ে যাক বিশ্বকাপে, পৌঁছে যাক সাকিবের হাতে

|

বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

আল মাহফুজ:  

এক ঝাঁক গাঙচিলের উড়াল
২০০৮ সাল। ‘আইসিএল’এ বাংলাদেশ জাতীয় দলের এক ঝাঁক ক্রিকেটারদের যোগদানে টালমাটাল দেশের ক্রিকেট। আইসিএলের আবির্ভাব তখন আইপিএলের প্রতিদ্বন্দ্বী (রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উভয়ই) হিসেবে। ফলত, ক্রিকেটের অভিভাবক আইসিসি একপ্রকার বাধ্য হয়েই আইসিএলে যোগ দেয়া ক্রিকেটারদের প্রতি ‘সমন’ জারি করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও আইসিএল খেলতে ক্রিকেটাররা পাড়ি জমান ভারতে, নিষেধাজ্ঞার নোটিশ ঝুলবে জানার পরেও।

কেন এমনটা ঘটেছিল? কারণ, সেই দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় হারিয়ে ফেলেছিলেন তাদের ফর্ম ও ফিটনেস। কেউ কেউ আবার জাতীয় দল থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। সেসময়ে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন সাকিব-তামিম-মুশফিকরা। এরা তখন রাজ করছিলেন না, তবে আগামীতে যে রাজ করবেন, সেই সম্ভাবনার যাত্রাপথ ঝিলিক মারছিল। অনেক খেলোয়াড়ের মনে শঙ্কার জায়গা ছিল এটাও। দলে তারা আর কখনও ফিরতে পারবেন না, এমনটা ভেবেই সানন্দে ‘বিদ্রোহী লীগে’ চলে যান। এতে সে অর্থে বড় কোনো ক্ষতি না হলেও তৎক্ষণাৎ তুমুল অনিশ্চয়তায় কেঁপে উঠেছিল দেশের ক্রিকেট। তখন কিউইদের বিপক্ষে সিরিজ, কিন্তু সব আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল)। ক্রিকেটপ্রেমি দর্শকরা হাহুতাশ করছিল, ক্ষুব্ধ হচ্ছিল; বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিল অনেকেই। কিন্তু সেই অনিশ্চয়তা আর খচখচে ক্ষতে প্রলেপ দিতে পেরেছিলেন মাশরাফী-আশরাফুলরা। কৌশিক রেশমি আলোর মতো জ্বলে উঠেছিলেন, আশরাফুল আরেকবার আশার ফুল হয়ে ফুটেছিলেন। তাদের যৌথ অবদানে কিউইদের বিপক্ষে প্রথম ওডিআইতে অপ্রত্যাশিত এক জয় পায় বাংলাদেশ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা থেকে যেন রাতারাতি গর্জন দেয়ার মতো অবস্থায় চলে গেছিল টাইগাররা। তারা ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল এক ঝাঁক গাঙচিলের উড়াল দেয়ার হাহাকার।

 

আইসিএল খেলতে গিয়েছিলেন জাতীয় দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা অনেকে। ছবি: সংগৃহীত

পোর্ট অব স্পেনে বাঘের গর্জন
পোর্ট অব স্পেন। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ। আইসিসি বিশ্বকাপ ২০০৭। বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ ভারত। ম্যাচের অন্তরালে ছিল অন্যরকম গল্প, হৃদয়বিদারক গল্প। ঠিক একদিন আগে খুলনায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় বাংলাদেশী দুই ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানা ও সাজ্জাদুল হাসান সেতু। সেই রানা, যিনি লাল-সবুজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশকিছু ম্যাচ খেলেছিলেন। সেই রানা, যিনি বাংলাদেশকে পরপর দুই ম্যাচ জিতিয়ে সিরিজ নিজেদের করতে পেরেছিলেন। প্রতিটি প্লেয়ারের মৃত্যু সতীর্থকে দুর্বল করে দেয়। প্রতিটি প্লেয়ারের মৃত্যু দেহের চোট হৃদয়ে নিয়ে যায়। এক সমুদ্র অশ্রু ঝরায় অথবা ভেতর থেকে স্তব্ধ করে।

রানার এই দুর্ঘটনা তার চেয়েও বেশি নাড়া দেয় মাশরাফীকে। রানা ছিল কৌশিকের একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দু’জনে মোটরবাইকে ঘুরতেন। চষে বেড়াতেন খুলনা বিভাগের এমাথা থেকে ওমাথা। প্রিয়সখার দুনিয়া ছেড়ে যাবার খবর তাই তাকে বিষণ্ণতার মোড়কে মুষড়ে দিয়েছিল বহুদূর কিন্তু হাল ছাড়েননি ম্যাশ, হাল ছাড়েনি দল। পরের দিন ক্ষুধার্ত শার্দূলের মতো মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। বল তো নয়, যেন চোয়ালবদ্ধ সংকল্প বেরুচ্ছিল একেকজন বোলারের মুঠো থেকে। গর্জনরত বাঘের মতো সপাটে চালাচ্ছিলেন তরুণ তামিম। সাকিব, মুশিরা ফিফটি করেই ম্যাচ পকেটে পুরে নেয়। আপনার কি মনে আছে, শেবাগের স্টাম্প ছত্রখান করে আঙ্গুল উঁচিয়ে সেদিন কী বলছিলেন ম্যাশ? মানজারুল রানার কথা, ম্যাচ জয়ের কথা, নাকি অন্য কোনো কিছু? রানার মৃত্যুর শোককে পোর্ট অব স্পেনে শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। মাশরাফী সম্ভবত সেকথাই বলছিলেন।

মাশরাফীর সেই উদযাপন! ছবি: সংগৃহীত

প্রিয় সাকিব আল হাসান,
হায়দরাবাদে ‘ক্যাপ্টেনস ডে’তে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে আপনি বলেছেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি ভালো হয়েছে। গত বিশ্বকাপের পর থেকে আমরা বাছাইপর্বে ৩ বা ৪ নম্বর দল ছিলাম পয়েন্টের হিসেবে। আমরা দল হিসেবে ভালো করেছি। এখন বিশ্বকাপে ভালো কিছু করে দেখানোর পালা। গতবার যা করেছিলাম, দেশ হয়তো এবার তার চেয়ে ভালো কিছু আশা করছে।’

হ্যাঁ সাকিব, গত কিছু দিন মাঠের বাইরে যা যা ঘটেছে, একটা টেস্টখেলুড়ে দল হিসেবে অপ্রত্যাশিত তা। ‘ভালো প্রস্তুতি’ বলতে আপনি যেটা বুঝিয়েছেন, সেটা হয়তো অনেকের কাছে ভালোর সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তবে আপনি এটা ঠিক বলেছেন, দেশ এবার ভালো কিছু আশা করছে। আমরা জানি, এতো এতো গুঞ্জন-সমালোচনা এক তুড়িতে উড়িয়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখেন কেবল আপনি। মাঠের ক্রিকেট দিয়ে আপনি চাপা দিতে পারেন গত ক’দিনের কাদা ছোঁড়াছুড়ি, অপেশাদারিত্বের অনাহুত সব কেচ্ছা। একারণেই উপরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুটি অনাহুত ঘটনা এবং সেখান থেকে ওভারকামের অবতারণা করা।

প্রিয় সাকিব আল হাসান, এই দল আপনার। আমরা জানি, এটাই সম্ভবত আপনার শেষ বিশ্বকাপ। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের আশা, মাঠের ক্রিকেটেই এই দেড় মাস আপনাদের পূর্ণ মনোযোগ থাকুক। আপনার দল খেলার বাইরে অন্য কোনো কিছু নিয়ে মাথা না ঘামাক। লর্ড বায়রন একদা লিখেছিলেন– ‘দেয়ার ইজ আ প্লিজার ইন দ্য পাথলেস উডস’। আপনাদের সে নির্মল আনন্দটা আমরা দেখতে চাই সবুজ ঘাসের কণায়। সে আনন্দের ছিটেফোঁটা হয়তো আমরাও পেতে চাই দর্শক হিসেবে, ক্রীড়া উপভোগের মাধ্যমে। এইটুকুন প্রত্যাশা নিয়ে খোলা চিঠিটি লেখা আপনার দরবারে। সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপটা বাংলাদেশ খেলুক ২০২৩’এ, এই শুভকামনা।

ইতি
একজন সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমি

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply