ইসরায়েলে হঠাৎ করে হামলা চালিয়ে বসে ফিলিস্তিনির স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। শনিবারের (৭ অক্টোবর) হামলার পর যুদ্ধ ঘোষণা করে তেল আবিব। এখন পর্যন্ত চলা এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষে প্রায় তেরো শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অনেকের মনে প্রশ্ন, সহসা কেন হামলা করলো ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। কিন্তু এই আক্রমণ এক দিনের ঘটনা নয়, যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে এই দ্বন্দ্ব। ক্ষুদ্র পরিসরে জেনে নেয়া যাক কী কী ঘটেছে এতো দিনে? ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সূত্রপাত কীভাবে?
মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মাঝে ছোট্ট একটি দেশ ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে গেলে ইহুদিরা ঘোষণা করে নিজস্ব রাষ্ট্র ইসরায়েলের। ১৯৪৯ সালে নবনির্মিত ইসরায়েল রাষ্ট্র আরব দেশগুলোর সঙ্গে বহু দিন ধরে চলা যুদ্ধ স্থগিত করে, যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে। ১৯৪৯ সালের চুক্তির অধীনে গাজা উপত্যকা মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ খাল নিয়ে সংকট তৈরি হয়, তখন ইসরায়েল মিশরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ এবং গাজা উপত্যকায় আক্রমণ করে। কিন্তু সেই সংকটে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ব্রিটেন, ইসরায়েল আর ফ্রান্সকে পিছু হটতে হয়।
১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা এবং আকাবা উপসাগরের এলাকা বাদ দিয়ে বাকি মিশরীয় ভূমি থেকে সেনা প্রত্যাহার করে। একইসঙ্গে তারা দাবি করে, গাজা উপত্যকা কখনও মিশরের অন্তর্গত ছিল না।
১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়, একে বলা হয় ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’। ৫ জুন থেকে ১০ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীতে। সেই সময়ে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা এবং সিনাই উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু আগে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো মিলে গঠন করে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দল ছিল ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ফাতাহ। পিএলও গঠিত হওয়ার পর এর বাহিনী ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ শুরু করে। প্রথমে তারা হামলা চালায় জর্দান থেকে। এরপর লেবানন থেকে।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ইয়োম কিপ্পুরে যুদ্ধ চলে। সেবছর ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়া যৌথভাবে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। ১৯ দিনের যুদ্ধে প্রায় ২৭০০ ইসরায়েলি সৈন্যের মৃত্যু হয়েছিল এবং সেই সময়ে প্রায় ৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন।
১৯৭৯ সালের ২৬ মার্চ ওয়াশিংটনে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায়) ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘ক্যাম্প ডেভিড’ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। এর ফলে সিনাই উপদ্বীপ থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করে ইসরায়েল। দুই দেশ অধিকৃত অঞ্চলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসনের অনুমতি দেয়ার জন্য একটি চুক্তির কাঠামো সম্মত হয়। তিন বছর পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিম তীর ও গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদা (ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মসজিদ থেকে শুরু হওয়া ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন) শুরু করেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা হামাস প্রতিষ্ঠা করেন এই সময়ে। সংকট আরও বাড়তে থাকে।
১৯৯৩ সালে তখনকার পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ইসরায়েলের সঙ্গে অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে সংঘাতের অবসান ঘটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। ওই চুক্তির জন্য ইয়াসির আরাফাত ও তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। চুক্তির বিরোধিতাকারী হামাস ইসরায়েলে ধারাবাহিক আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়।
১৯৯৭ সালে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৭ জন নিহত হয়। ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজ বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ চালাবেন তিনি। এই ঘটনা তিনি সহজভাবে মেনে নেবেন না বলে জানান।
২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাম্প ডেভিডে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছায়। তার কয়েক মাস পরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। ইসরায়েলি পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে ফিলিস্তিনি যুবকরা। ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই করার প্রস্তুতি নেয় হামাস। তার কারণে হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে ফিলিস্তিনে।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে গাজা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় ইসরায়েলি সৈন্যরা। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নির্দিষ্ট এলাকার ভেতর চলাচল এবং বাইরে আসার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করে ইসরায়েল। এতে আন্তর্জাতিক মহলে তারা সমালোচনার মুখে পড়ে।
আধাসামরিক সংস্থা ফাতাহ’র প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর প্রায় এক বছর পরে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে হামাস ফিলিস্তিনের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। এক বছর পরে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ফাতাহ বাহিনী সরে যায়।
গাজা থেকে রকেট হামলার জবাবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে হামাসের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েল। যাতে নিহত হয় ২০০ ফিলিস্তিনি। পরবর্তীতে, হামাসের বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধ শুরু করে তারা। এ ঘটনায় মোট ১২০০ ফিলিস্তিনি ও ১৩ ইসরায়েলি নিহত হয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এরপর গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ইসরায়েল এবং স্ট্রিপের সীমারেখা পুনরায় মোতায়েন করা হয়।
২০১২ সালের নভেম্বরে হামাসের সামরিক প্রধান আহমেদ জাবারিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এরপরে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে গুলি বিনিময় শুরু হয়। তাতে ১৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং কমপক্ষে ছয় জন ইসরায়েলি নিহত হয়।
২০১৪ সালে ইসরায়েলের তিন কিশোরকে অপহরণ করে হত্যা করে হামাস। যার ফলে রকেট হামলা শুরু হয় ইসরায়েলের দিক থেকে। তাতে ১৮৮১ জন ফিলিস্তিনি এবং ৬০ জনেরও বেশি ইসরায়েলির মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালে গাজা ও ইসরায়েলের সীমানায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ফিলিস্তিনি যুবকরা। সেখানে ইসরায়েলের সেনা আক্রমণ করায় ১৭০ জনের মতো ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি পুলিশ জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে অভিযান চালায়। এটিকে ‘ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান’ বলে অনেকেই মনে করেন। এখানে আক্রমণ হওয়ায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ১১ দিনের যুদ্ধ শুরু হয়। তাতে ২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি এবং ১৯ জনেরও বেশি ইসরায়েলির মৃত্যু হয়।
২০২২ সালে ইসরায়েলি শহরগুলোতে হামলা হওয়ার পর সেদেশের সেনাবাহিনী ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে কমপক্ষে ১৬৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। বিক্ষোভ হয় ফিলিস্তিনজুড়ে।
চলতি বছর বেশ কয়েক বার ইসরায়েলি বাহিনী জেনিনে সামরিক অভিযান চালায়। জানুয়ারিতে পূর্ব জেরুজালেমের একটি সিনাগগে ৭ জনকে হত্যা করে আবার একজন ফিলিস্তিনি। এরপর থেকেই মূলত জারি রয়েছে এই সংকট।
/এএম
Leave a reply