হরতাল ও অবরোধের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী, কোনটা বড়?

|

২০২২ সালে বাম জোটের হরতালের সময়ে তোলা ছবি।

আসন্ন নির্বাচন ঘিরে উত্তাল রাজনীতি। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে রাজনীতির ময়দান সরগরম করে রেখেছে সরকার বিরোধীরা। স্বাভাবিকভাবেই ‘হরতাল’ আর ‘অবরোধ’র মধ্যে পার্থক্য কী– এই প্রশ্নটি ঘোরাফেরা করছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।

হরতাল ও অবরোধের মধ্যকার ফারাক ধরতে পারেন না অনেকেই। প্রায়ই দেখা যায়, দুটি কর্মসূচিতেই থাকে একই ধরনের রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এ দুটোর মধ্যে আদতে মিল থাকলেও হরতাল আর অবরোধের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। একনজরে দেখা নেয়া যাক সেই ফারাকগুলো।

হরতাল
‘হরতাল’ শব্দটি উদ্ভূত গুজরাটি শব্দ থেকে। ‘হর’ মানে সবজায়গায় আর ‘তাল’ মানে তালা। অর্থাৎ, হরতাল অর্থ হলো সবজায়গায় তালা। ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে হরতাল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন মহাত্মা গান্ধী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হরতাল হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন। হরতালের সময় সকল কর্মক্ষেত্র, গাড়িঘোড়া, অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। হরতালে দোকানপাট, স্কুল কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এক কথায় সব কিছু অচল করে দেয়ার রাজনৈতিক কর্মসূচি হচ্ছে হরতাল।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ‘তমুদ্দিন মজলিস’ প্রথম হরতালের ডাক দেয়। এরপর থেকে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে হরতাল বেশ প্রচলিত একটি কর্মসূচি। বাংলাদেশে যেটা হরতাল, ভারতে সেটাকে ‘বনধ’ বলে।

কোনো ইস্যুতে কোনো রাজনৈতিক দল হরতালের ডাক দিলে সাধারণত মানুষ তাতে সাড়া দেয়। অর্থাৎ মানুষ হরতালের ইস্যুর সাথে একমত হয়ে পরিবহণ, দোকানপাট, অফিস-আদালত বন্ধ রাখবে। তবে অ্যাম্বুলেন্স, দমকলবাহিনী, গণমাধ্যম এর আওতার বাইরে থাকে। হরতাল পালনে মানুষকে বাধ্য করা হয় না।

অবরোধ
হরতালের মতো অবরোধেরও রয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। কোনো দুর্গ বা এলাকা দখলের আগে নানা যুগে অবরোধের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। গ্রিক মিথোলজিতে (ইলিয়াড ও ওডেসি) ট্রয় নগরী অবরোধের কথা উঠে এসেছে। রানি হেলেনকে অপহরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় দশ বছর ট্রয় অবরোধ করে রেখেছিল গ্রীকরা। এই অবরোধের জেরেই পরে ধ্বংস হয় ঐতিহাহিক ট্রয় নগরী।

অবরোধের ইংরেজি প্রতিশব্দগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ব্লকেড’। উইকিপিডিয়া এর অর্থ দাঁড় করাচ্ছে, একটি অঞ্চল অথবা জনশক্তিকে সক্রিয়ভাবে খাদ্য, পণ্য, অস্ত্র বা যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা বা প্রতিরোধ করার কাজ। এটা সাধারণত সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত হয়। আমরা যদি জেরুজালেম অবরোধের (১১৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত) দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই– ওই সময়ে শহর থেকে বের হতে শহরের নাগরিকদের মুক্তিপণ দিতে হতো মিশরের আইউবীয় সুলতান সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীকে।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবরোধ কর্মসূচির অর্থ হচ্ছে কোনো দাবি আদায়ের একটি বিশেষ ব্যবস্থা। অবরোধ হচ্ছে কর্মসূচি পালনে জনগণকে বাধ্য করা। অবরোধে যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়, পরিবহন চলতে দেয়া হয় না। এক শহর থেকে আরেক শহরে কিংবা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পরিবহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘হরতাল’ আর ‘অবরোধ’ কর্মসূচির মধ্যে অনেক সময় পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।

২০১৩ সালের নভেম্বরে বিএনপির অবরোধ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি দলটির নেতারা। তখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছিলেন, আমরা এটিকে নির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করছি না। অবরোধ বলতে রাজপথ, রেল ও নৌপথ অবরোধ করে রাখাকে বোঝাচ্ছি। তবে বড় কর্মসূচিতে বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটে যায়। এ জন্য সতর্ক থাকাই ভালো।

হরতাল বড়, নাকি অবরোধ?
রাজনীতিবিদরা মনে করেন, অবরোধের চেয়ে হরতাল বড় কর্মসূচি। এটা একেবারে চূড়ান্ত কর্মসূচি। কেননা, দলের দাবির প্রতি এতে সাধারণ মানুষ একমত পোষণ করে থাকে। বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন না পেলে হরতালে সফলতা পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, অবরোধে মানুষকে বাধ্য করার বিষয় থাকে। তাই এতে মানুষের কতটুকু সমর্থন আছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায় না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হরতাল হচ্ছে ভোট বা জরিপের মতো। হরতাল সফল হলে বোঝা যাবে, দলটির দাবির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন আছে। এটি পরিচালিত হয় ‘তুলনামূলক’ শান্তিপূর্ণ পথে। অন্যদিকে, অবরোধে যেহেতু জোর করার ব্যাপার থাকে, অনেক ক্ষেত্রে তাই এটি সহিংস হয়ে উঠতে পারে।

তবে আমাদের দেশে এ দুই কর্মসূচির ধরন প্রায় একই। ‘হরতাল’ ও ‘অবরোধ’— দুই কর্মসূচিতেই জনগণকে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটে। কর্মসূচিকে ঘিরে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেখা যায়।

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply