বিতর্কিত নোবেল বিজেতা হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ‘মার্কিন কূটনীতির প্রতীক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ইতিহাস তাকে কীভাবে মনে রাখবে? মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম রূপকার হিসেবে? নাকি যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী চিন্তার ব্যক্তি হিসেবে?
দুই দশক ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের ময়দান থেকে মার্কিন বাহিনীকে ফিরিয়ে আনায় ভূমিকা রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭৩ সালে ২৭ জানুয়ারি কিসিঞ্জার ও লি ডাক থো ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে ‘প্যারিস শান্তি চুক্তি’ সই করেন। এই চুক্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন তারা।
নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন সংক্রান্ত তথ্য ৫০ বছর গোপন রাখার নিয়ম রয়েছে। যেহেতু এই সময় পেরিয়ে গেছে, এক আবেদনের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের শুরুতে হেনরি কিসিঞ্জারকে মনোনয়ন দেয়া সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে নোবেল কমিটি।
জানা গেছে, কিসিঞ্জারের প্রচেষ্টা ভিয়েতনামে ‘শান্তি ফেরাতে পারবে না’ এরকম আশঙ্কা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত থাকার পরও পুরস্কারের জন্য তাকেই বাছাই করা হয়। শুধু তাই নয়, প্যারিস চুক্তির জন্য সেসময়ে শুধু কিসিঞ্জারকে পুরস্কার দেয়াটা যথার্থ মনে হয়নি কমিটির কাছে। এই চিন্তা থেকে লি ডাক থো সম্পর্কে বিশদ না জেনেও তার নাম জুড়ে দেন প্রস্তাবকারীরা। প্যারিস চুক্তিতে হ্যানয়ের (তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী) প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন থো।
১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সমর্থিত কমিউনিস্টপন্থী উত্তর ভিয়েতনাম ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে চলে এই রক্তক্ষয়ী লড়াই। শুরু থেকেই স্নায়ুযুদ্ধের অংশীদার হলেও ষাটের দশকে সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন সেনাদের ব্যাপক প্রাণহানি ও মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির কারণে সত্তরের দশকের শুরুতেই মার্কিন জনগণের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। মনোবল ভেঙে যেতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদেরও। সব মিলিয়ে ভিয়েতনাম থেকে পিছিয়ে আসাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একমাত্র উপায়।
হেনরি কিসিঞ্জার সেই কাজটিই করেছিলেন। প্যারিস চুক্তির মূল বিষয় ছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা। তবে তার এই প্রচেষ্টার কারণে ভিয়েতনামে শান্তি আসেনি। ১৯৭৫ সালে অশান্তির যবনিকা ঘটে, যখন উত্তর ভিয়েতনামের বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন দখল করে নেয়।
রয়টার্স জানায়, প্যারিস শান্তি চুক্তির দুদিন পর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য হেনরি কিসিঞ্জার ও লি ডাক থোর নাম প্রস্তাব করা হয়। উত্তর ভিয়েতনামের মুখ্য শান্তি আলোচক লি ডাককে যখন পুরস্কৃত করা হয়, তখন তিনি বিশ্বাস করতেন– এই চুক্তির কারণে তার দেশে শান্তি ফিরবে না। তাই তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করেননি। তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, ভিয়েতনামে অস্ত্রের ঝনঝনানি কমলে এবং সত্যিকার অর্থে ‘প্যারিস চুক্তি’ বাস্তবায়িত হয়ে শান্তির পায়রা নেমে এলে তখন পুরস্কার নেয়ার কথা বিবেচনা করবেন।
থো পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানালেও কিসিঞ্জার তা করেননি। তিনি পুরস্কারটি বগলদাবা করে ঘরে তুলেছিলেন। বিতর্ক ওঠায় পরে আবার পদকটি ফিরিয়েও দিতে চেয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কারে কিসিঞ্জারকে ভূষিত করা হলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বিতর্কিত এই সিদ্ধান্তের জেরে পদত্যাগ করেন নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুজন সদস্য।
‘প্যারিস শান্তি চুক্তি’ ছিল কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ, এমনটা মনে করার লোকের অভাব নেই। তবে সমালোচকদের মত, কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না, বরং যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন। নানা বিতর্কিত ভূমিকার জন্য অনেকেই তাকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলেও অভিযুক্ত করে থাকেন।
পুরস্কার প্রাপ্তি একজন সৃজনশীল শিল্পী অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আরও কাজ করতে উৎসাহ যোগায়। যদি শান্তির পায়রা ততোদিনে মাটিতে নেমে নাও আসে, ভবিষ্যতে আসবে– এমনটা ভেবেই হয়তো কিসিঞ্জারদের পুরস্কার দেয়া হয়। যদিও সত্যিকারের মানুষেরা পুরস্কারের কথা মাথায় রেখে কাজ করেন না। যদিও সত্যিকারের রাজনীতিবিদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে মানুষের কল্যাণ। তবে এটাও ঠিক, লি ডাক থোর মতো কেউ কেউ থাকেন; যারা প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারকে বর্জন করতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেন না।
গ্রন্থনা: আল মাহফুজ
Leave a reply