শাহরুখ খান, নামটি মাথায় আসতেই ভেসে ওঠে নানা ধরনের দৃশ্য। এই নামে রয়েছে মুগ্ধতা, রয়েছে জাদুময়তা অথবা রয়েছে একটি হাসি, যা নিমিষেই জুড়িয়ে দেবে হৃদয়। কিন্তু নিছক চেহারা দিয়ে বলিউডের রাজা হিসেবে তার আবির্ভাবের পথটা খুব সহজ ছিল না। তার জীবনের গল্পের পারদে পারদে রয়েছে দৃঢ়তা। রয়েছে দৃঢ় সংকল্প ও স্বপ্নের আশায় ছুটে চলা একজন নাবিকের হার না মানা পথচলার গল্প।
দিল্লির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শাহরুখ। জীবনের শুরুতেই মুখোমুখি হতে হয় বহু বিড়ম্বনার। অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে বুকে নিয়ে বেড়াতে হয়েছে এক সমুদ্র কষ্ট। তবে সেই ব্যথার উপশম পেতেন থিয়েটার আর গল্প বলার মধ্যে।
শুরুর সেই বন্ধুর পথে যাত্রা সুখকর ছিল না, কিন্তু প্রতিভা ছিল অফুরন্ত। ফলে সীমাবদ্ধ কোনো গণ্ডিতে আটকে রাখা যায়নি তাকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অপমানিত ও উপেক্ষিত হয়ে একরাশ স্বপ্ন ও স্যুটকেস হাতে নিয়ে অবশেষে মুম্বাই পাড়ি জমান। সেখানে এসেও নানামুখী প্রত্যাখ্যানের দেখা পান।
কিন্তু কোনো প্রত্যাখ্যানই দমাতে পারেনি শাহরুখকে। নিজের কর্মদক্ষতাকে প্রতিনিয়ত উন্নতির মাধ্যমে নিয়ে যান অন্য এক উচ্চতায়। প্রতিটি বিষয় থেকে অর্জন করেন অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। অবশেষে খুঁজে টেলিভিশনে পোক্ত করেন নিজের শক্ত অবস্থান।
স্ক্রিনে তার অঙ্গভঙ্গি, সংলাপ ও অভিনয় দর্শকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। নিজেকে তৈরি করেন সিনেমার উপযোগী করে। ১৯৯২ সালে শাহরুখের অভিষেক ঘটে বলিউডে। ‘দিওয়ানা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শুরু হওয়া তার সেই যাত্রা এখন ইতিহাস। পরের বছর ‘ডর’ ও ‘বাজিগর’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জাত চেনান। সফলতারও দেখা পান। তবে সে সাফল্য নায়ক হিসেবে নয়, ‘এন্টি হিরো’ হিসেবে।
এরপর ১৯৯৫ সালে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’র মাধ্যমে ছুঁয়ে ফেলেন মাইলফলক। এই চলচ্চিত্রটির প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেন শাহরুখ ও কাজল। সিনেমাটি যেন ভারতীয় ঐতিহ্য ও বৈশ্বিক পটভূমির মিশেল। চিরাচরিত নিটোল প্রেমের গল্প। এ সিনেমায় শাহরুখ নিজেকে মেলে ধরেন একজন ‘রোম্যান্টিক নায়ক’ হিসেবে।
চলচ্চিত্রটি ভারতে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন রুপি এবং দেশের বাইরে ১৬০ মিলিয়ন রুপি আয় করে। হয়ে ওঠে সে বছরের বলিউডের সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্র। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘ডিডিএলজে’ ইতিহাস সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র হিসেবে পরিচিত।
দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন শাহরুখ। ধীরে ধীরে উপহার দেন ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’ ও ‘কাভি খুশি কাভি গাম’র মতো আইকনিক কিছু সিনেমা। যার মোহনীয়তা ভারতের সীমানা অতিক্রম করে চলে যায় বাকি দুনিয়ায়। বিশ্ব দরবারে আলোচনার জন্ম দিয়ে ভক্তদের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন ‘বলিউড বাদশাহ’।
কিন্তু নামটা যে শাহরুখ খান! তাই শুধু রোমান্টিক নায়ক হয়েই ক্ষ্যান্ত দেননি তিনি। ‘চাক দে! ইন্ডিয়া’, ‘স্বদেশ’ ও ‘পাহেলি’র মতো চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ক্যারেক্টারে অভিনয় করে প্রদর্শন করেন নিজের অভিনয়ের বৈচিত্র্য ও গভীরতা।
এরপর আবির্ভূত হন একজন প্রযোজক হিসেবে। টেলিভিশনের উপস্থাপকের ভূমিকায়ও দেখা যায় তাকে। নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেন নানা সময়ে জনস্বার্থে কাজ করে।
তবে লম্বা এ যাত্রায় শাহরুখকে মুখোমুখি হতে হয়েছে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জেরও। ব্যক্তিগত ইস্যু থেকে শুরু করে বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যু একহাতে সামলেছেন। সামলেছেন সমালোচনাও। ‘ফ্যান’ থেকে ‘জিরো’, এই সময়টাতে ভালো ব্যবসা করতে পারেনি তার সিনেমা। তখন নিন্দুকেরা আওয়াজ তুলেছিল, ফুরিয়ে গেছেন শাহরুখ। কিন্তু ‘ডন’ ফুরাননি, হারিয়ে যাননি। যতবার তাকে নিয়ে ‘শেষের গল্প’ তৈরি হয়েছে, ততবার ‘কিং খান’ বেশে ফিরে এসেছেন। আরও শক্তিশালী হয়েছেন। তার দেখাদেখি অনুপ্রাণিত হয়েছে লক্ষ-কোটি ভক্ত সমর্থকও।
আজ এই সময়ে এসে শাহরুখ শুধু বলিউড সুপারস্টার নয়, নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের বিশ্বদূত হিসেবে। স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছেন সাংস্কৃতিক আইকনের প্ল্যাকার্ড হাতে।
এসব গল্পই তার কঠোর পরিশ্রম, প্রতিভা আর অটুট বিশ্বাসের শক্তির প্রমাণ। শাহরুখের এই জার্নি প্রমাণ করে, নিতান্ত সাধারণ একটি জায়গা থেকেও গড়ে তোলা যায় ইতিহাস। সাধারণ সূচনাও শেষ হতে পারে অসাধারণ উপসংহারের মধ্য দিয়ে। শাহরুখ খান বুঝিয়েছেন– স্বপ্ন যতোই বড় হোক, তা সত্যি হতে পারে কেবল নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে।
‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’— এই গানটি এখন শাহরুখ খানের কণ্ঠেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি মানায়।
এমএইচ/এএম
Leave a reply