মিশুক নজিব ⚫
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের…
— লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ, স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতায়। কবি তার কবিতায় বলেছেন স্বাধীনতা আসার গল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণই এনে দেয় স্বাধীনতা। এর প্রেক্ষাপট বেশ দীর্ঘ, সে গল্প বাংলাদেশিদের জানা। সত্তরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধে জড়ায় বাঙালিরা। পরের বছরই বিশ্ব মানচিত্রে যুক্ত হয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। দেশের মানুষ পায় স্বাধীন দেশের পতাকা।
যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ-স্বাধীনতা, সেই ভোট স্বাধীন বাংলাদেশে আসে তিয়াত্তরের মার্চে। বিজয়ের ১৪ মাস পরে। দিনক্ষণটিও বেশ চমৎকার। মুজিবের সেই ভাষণের ঠিক দুই বছরের মাথায়, ৭ মার্চ।
এই ভোটেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচেটিয়া জয় পায় আওয়ামী লীগ। সত্তরের ভোটেও নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল এই দল। অবশ্য আগে থেকেই আভাস ছিল, স্বাধীন বাংলার প্রথম ভোটে নৌকার জয় হবে। যে দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, যুদ্ধের পর তারাই ক্ষমতায় যাবে, এটা ছিল স্বাভাবিক।
৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের দখলে থাকে ২৯৩টি আসন। বাকি ৭ আসনের মধ্যে ৫টিতে জয় পায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বিরোধী রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন লাভ করে। যার একটি পান জাতীয় লীগের বর্ষীয়ান নেতা আতাউর রহমান খান আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আবদুস সাত্তার।
এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ১৪টি দল। এরমধ্যে আওয়ামী লীগই কেবল ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এই ভোটে দলটির ১১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় বিজয়ী হওয়াদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানও। তার নির্বাচনী আসন ছিল ঢাকা-১২। একটি আসনে প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ভোট স্থগিত হয়েছিল। ৪ এপ্রিল সেই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
নির্বাচনের তারিখ | ৭ মার্চ ১৯৭৩ |
মোট ভোটার | ৩ কোটি ৫২ লাখ ৫ হাজার ৬৪২ |
ভোট দিয়েছেন | ১ কোটি ৯৩ লাখ ২৯ হাজার ৬৮৩ (৫৪.৯০%) |
মোট আসন | ৩০০ |
সংরক্ষিত মহিলা আসন | ১৫ |
অংশগ্রহণকারী মোট দল | ১৪ |
ফলাফল:
রাজনৈতিক দল | মোট প্রার্থী | প্রাপ্ত আসন | শতাংশ | দলের প্রতীক |
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | ৩০০ | ২৯৩ | ৭৩.২ | নৌকা |
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল | ২৩৭ | ১ | ৬.৫২ | মশাল |
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) | ২২৪ | ০ | ৮.৩৩ | কুড়েঘর |
ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি (ভাসানী) | ১৬৯ | ০ | ৫.৩২ | ধানের শীষ |
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি | ৪ | ০ | ০.২৫ | চাবি |
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (এল) | ২ | ০ | ০.১ | গরুর গাড়ী |
জাতীয় লীগ | ৮ | ১ | ০.৩৩ | লাঙ্গল |
বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি | ৩ | ০ | ০.০৬ | কুড়াল |
স্বতন্ত্র প্রার্থী | ১২০ | ৫ | ৫.৫২ | — |
এছাড়া, বাংলা জাতীয় লীগ ১১, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস ৩, জাতীয় গণতন্ত্রী দল ৩, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ৩, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন ৩ এবং বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। তবে তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল এক শতাংশের নিচে।
এই সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস, তেয়াত্তরের ৭ এপ্রিল থেকে পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। সংসদের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৫ এর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি সংসদ নেতা ছিলেন। পরদিন তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। আর সংসদ নেতা হন মোহাম্মদ মনসুর আলী। এই সংসদ তিনজনকে স্পিকার হিসেবে পায়। তারা হলেন শাহ আব্দুল হামিদ, মোহাম্মদ উল্লাহ ও আব্দুল মালেক উকিল। জয়ী ৩০০ সংসদ সদস্যের মধ্যে কোনো নারী ছিলেন না। তবে, সংরক্ষিত মহিলা আসনে ১৫ জন সংসদ সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার তেজগাঁওয়ের তৎকালীন সংসদ ভবনে।
ক্ষমতাসীনদের অধীনে এই নির্বাচন একেবারে বিতর্কমুক্ত ছিল না। প্রয়াত রাজনীতিবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ের ১৪২ পৃষ্ঠায় ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্ক বলেছেন, ‘এ নির্বাচন সর্বাংশে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছিল, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো আসনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে বলপূর্বক পরাজিত করা হয়েছে বলে নির্বাচনের পর অভিযোগ আনা হয়।’
তবে, ভোট নিয়ে বিরোধীদের কিছু অভিযোগ থাকলেও তা বেশ শক্তপোক্ত না। এই নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করেছিলেন এনায়েতুল্লাহ খান। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। সরকারবিরোধী বামপন্থীদের প্রতি সহানুভূতি ছিলেন এনায়েতুল্লহ খান। তার মতে, একেবারে ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন হলেও ফলাফলের গুরুত্বপূর্ণ হেরফের হতো না। বিরোধী পক্ষ খুব জোর আর দশটি আসনে জয়লাভ করতো।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, বিরোধীরা ১৫ জনের বেশি প্রার্থীর নামও বলতে পারেনি, যাদেরকে জোর করে হারানো হয়েছে বলে তাদের দাবি ছিল।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ান-এর সাংবাদিক ওয়াল্টার শশার্জের মতে, জাতিসংঘের পরিচালনায় ও রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও শেখ মুজিবুর রহমান (এর দল) অনায়াসে জয়লাভ করতেন।
মার্কিন সাময়িকী টাইম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিজয় কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল না। তবে পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, তাই তারা একেবারে সুবিধা পায়নি তা নয়। তবে এটাও বাস্তব যে বিরোধী দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামো তত ভালো ছিল না। আওয়ামী লীগের তুলনায় বেশ দুর্বল ছিল। আর শেখ মুজিবের মতো নেতৃত্বও ছিল না বিরোধী শিবিরে।
এছাড়া, পরাজয়ের জন্য বিরোধীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও কম দায়ী ছিল না। সরকারের বিরুদ্ধে সে সময় তারা ইতিবাচক কোনো কর্মসূচির ঘোষণা দেয়নি। সরকারের ব্যর্থতার প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচন করে। দলগুলো ছিল ভারতবিরোধী। দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য তারা ভারত-রাশিয়াকে দায়ী করে। তবে, সে কৌশল ভোটের মাঠে কাজে লাগেনি।
এই ভোটে ব্যক্তিবাদের প্রভাব ছিল। আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে শেখ মুজিবের ব্যক্তি ইমেজের ওপর নির্ভর ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), জসদের পোস্টারেও তাদের নিজ নিজ নেতার ভাবমূর্তি ব্যবহারের চেষ্টা ছিল।
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় শেখ মুজিব ১২ ফ্রেবুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৯টি বড় বড় নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করেন। এই নেতার দেয়া সেসব বক্তব্যে ঘুরে-ফিরে উঠে আসে— সংবিধানে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চিয়তা দেয়া হয়েছে। জনগণই সকল সম্পদের মালিক। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়, তবে ধর্মের নামে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে চায় এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাই, জনগণ আমার পেছনে ঐক্যবদ্ধ আছে, তারা সংবিধানে সন্নিবেশিত মূলনীতিসমূহের প্রতি অনুগত ও শোষণহীন। সমাজ বিনির্মাণে প্রস্তুত।
ভোটের আগে বিরোধী দলসমূহের তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার প্রণীত সংবিধানের বৈধতা প্রমাণের প্রয়োজন ছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে এই বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়। আর নির্বাচনী জনসভায় দেয়া বক্তব্যে সংবিধানের বিষয়ে কথা বলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এই ভোটে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. ইদ্রিস। যিনি সাবেক বিচারপতি ছিলেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম সিইসি। ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই নিয়োগ পেয়েছিলেন মো. ইদ্রিস। তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে।
Leave a reply