মিশুক নজিব ⚫
২৪ মার্চ ১৯৮২, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতা দখল করেই দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন জেনারেল এরশাদ। আর বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
ক্ষমতায় বসে তিনি নতুন এক শ্লোগান চালু করেছিলেন, সেটি ছিল ‘নতুন বাংলাদেশ, গড়ব মোরা…।’ এই শ্লোগান দিয়ে গানও লিখেছিলেন এরশাদ। তবে তার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররাই প্রথম প্রতিবাদ করে বসেন। একপর্যায়ে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। যা চলে নব্বইয়ের শেষভাগ পর্যন্ত। এরইপ্রেক্ষিতে ’৯০ এর ৬ ডিসেম্বর মসনদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন এরশাদ।
তার শাসনামলে তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুবারই ক্ষমতায় আসে তার জাতীয় পার্টি। দুটি নির্বাচন নিয়েই ছিল প্রশ্ন।
তৃতীয় সংসদ নির্বাচন:
আন্দোলন দমনের চেষ্টার পাশাপাশি রাজনীতিক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সে সময় তৎপর হন জেনারেল এরশাদ। ১৯৮৬ সালের পহেলা জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে তার দল জাতীয় পার্টি। তিনি বিভিন্ন দল থেকে জাতীয় পার্টিতে ভেড়ান মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ ও মওদুদ আহমেদসহ অনেক রাজনীতিবিদকে।
আর এই দলই ওই বছরের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। এই ভোটে ১৫৩টি আসন পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। আগের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করা বিএনপি এ ভোটে অংশ নেয়নি। অনেক নাটকীয়তার পর এতে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) তিনটি অংশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফ্ফর), ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) প্রভৃতি দল। ৭৬টি আসনে জয়ী হয়েছিল নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। জামায়াত পেয়েছিল ১০টি আসন, দল হিসেবে যা ছিল তৃতীয়। ৩২টি আসনে জয় পায় স্বতন্ত্র প্রার্থী। ভোটের পর তারা জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিল।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করে ১ হাজার ৫২৭ প্রার্থী। ভোটার সংখ্যা ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৫ হাজার। এরমধ্যে ২ কোটি ৮৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৫০টি ভোট পড়ে। যা মোট ভোটারের ৬১.১ শতাংশ। সংসদ নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। প্রথমবারের মতো সদস্য হয়ে সংসদে যান তিনি। এই সংসদ নির্বাচনের পরে জাতীয় পার্টি থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন এরশাদ।
দল | প্রাপ্ত ভোট | ভোটের হার | আসন |
জাতীয় পার্টি | ১,২০,৭৯,২৫৯ | ৪২.৩৪ | ১৫৩ |
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ | ৭৪,৬২,১৫৭ | ২৬.১৬ | ৭৬ |
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী | ১৩,১৪,০৫৭ | ৪.৬১ | ১০ |
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব) | ৭,২৫,৩০৩ | ২.৫৪ | ৪ |
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ | ৪,১২,৭৬৫ | ১.৪৫ | ৪ |
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি | ৩,৬৯,৮২৪ | ১.৩ | ৫ |
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি | ২,৫৯,৭২৮ | ০.৯১ | ৫ |
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (সিরাজ) | ২,৪৮,৭০৫ | ০.৮৭ | ৩ |
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফফর) | ২,০২,৫২০ | ০.৭১ | ২ |
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ | ১,৯১,১০৭ | ০.৬৭ | ৩ |
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি | ১,৫১,৮২৮ | ০.৫৩ | ৩ |
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন | ১,২৩,৩০৬ | ০.৪৩ | ০ |
জন দল | ৯৮,১০০ | ০.৩৪ | ০ |
বাংলাদেশ নাগরিক সংহতি | ৬৮,২৯০ | ০.২৪ | ০ |
ইসলামী যুক্তফ্রন্ট | ৫০,৫০৯ | ০.১৮ | ০ |
জাতীয় জনতা পার্টি (ওদুদ) | ৪৬,৭০৪ | ০.১৬ | ০ |
বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) | ৩৬,৯৪৪ | ০.১৩ | ০ |
গণ আজাদী লীগ | ২৩,৬৩২ | ০.০৮ | ০ |
বাংলাদেশ ইসলামিক আন্দোলন | ২২,৯৩১ | ০.০৮ | ০ |
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম | ৫,৬৭৬ | ০.০২ | ০ |
জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম-নেজামে ইসলাম পার্টি | ৫,৫৭২ | ০.০২ | ০ |
প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল | ২,৯৯৭ | ০.০১ | ০ |
জাতীয় জনতা পার্টি (সুজাত) | ১,৯৮৮ | ০.০১ | ০ |
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ | ১,৯৮৫ | ০.০১ | ০ |
বাংলাদেশ হিন্দু ঐক্যফ্রন্ট | ১,৩৩৮ | ০ | ০ |
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল | ১৪৯ | ০ | ০ |
ইয়ং মুসলিম সোসাইটি | ১৪১ | ০ | ০ |
বাংলাদেশ ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টি | ১১০ | ০ | ০ |
স্বতন্ত্র | ৪৬,১৯,০২৫ | ১৬.১৯ | ৩২ |
জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে ‘সরকারি দল’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল বিরোধী পক্ষের তরফ থেকে। বহু জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের পক্ষে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার অভিযোগ ওঠে। ‘মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশনে ফলাফল পাল্টে দেয়ার বিষয়ে অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগের। দলটি এখনও এরশাদ আমলের দুই সংসদ নির্বাচনের সমালোচনা করে থাকে।
বিরোধীদের তরফ থেকে আওয়ামী লীগেরও সমালোচনা করা হয়, এই ভোটে অংশ নেয়ায়। তবে, স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
সেই সময় এরশাদের সঙ্গে সংলাপের কথা উল্লেখ করে একাদশ জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময় আমাদের ১৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা ছিল। আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন।
তৃতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির ভাষ্য, ওই নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ হতো তাহলে দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকতো এবং এরশাদকেও বিতর্কিত হতে হতো না। নিজেই আবার পরবর্তীতে সংসদ ভেঙে দিয়ে আবারও বিতর্কের মুখে পড়েন। ৮৮ সালের নির্বাচনে প্রায় কোনো দলই অংশগ্রহণ করেনি। এরপরই আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং জনগণের আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ তৃতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে অংশ নেয়নি। পরে অবশ্য তারা সংসদে যোগ দেয়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতেই, এই নির্বাচনের অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ থেকে বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে একটা উপলব্ধির জন্ম দেয় যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন পুরোপুরি অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না।
এই সংসদ বেশি দিন টেকেনি। ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচন:
তৃতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার পর পরবর্তী ভোটের জন্য তোড়জোড় শুরু করেন এরশাদ। কিন্তু এই নির্বাচনে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় কেউই অংশ নেয়নি। ছিয়াশির নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তারা ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৫১টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে মোট আটটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে৷ ১৯টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ)। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী ২৫টি, জাসদ (সিরাজ) তিনটি ও ফ্রিডম পার্টি দুটি আসন লাভ করে। এছাড়া, ভোটে অংশ নিয়েও কোনো আসন পায়নি চার দল। সেসব দল হলো বাংলাদেশ খিলাফত আন্দোলন, তেইশ দলীয় জোট, গণতন্ত্র বাস্তবায়ন পার্টি ও জন দল।
বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টি দুটি আসন পেলেও রাজনীতির মাঠে কৌতুহল সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে হত্যাকারী কয়েক ব্যাক্তিই আশির দশকে এই দল গড়ে তুলেছিলেন।
এই সংসদ দুইজনকে প্রধানমন্ত্রী পান। তারা হলেন মওদুদ আহমেদ ও কাজী জাফর আহমেদ। বিরোধীদলীয় নেতা হন আ স ম আব্দুর রব।
রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার রাজনীতির তিনকাল বইয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বিষয়ে লিখেছেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো আগেই এ নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের কথা ঘোষণা করেছিল। ফলে দেখা গেল মাঠে জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কেউ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে নাম, সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব কিছু ‘পায়ে দল’, ‘হোন্ডা দল’কে বিরোধী দল আখ্যা দিয়ে আসন ছেড়ে দেয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনে নামতে রাজি করানো হয়।
দুই বছর সাত মাস মেয়াদ ছিল এই সংসদের। এরশাদ আমলের দুই সংসদই ভাঙার তারিখ ৬ ডিসেম্বর। প্রথবার সাতাশি সালে, দ্বিতীয়বার নব্বইয়ে। গণআন্দোলনে শেষবার কেবল সংসদ ভেঙে দেয়া নয়, এরশাদ নিজেও পদত্যাগ করেন রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে। এরপর থেকে ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির পথ সংকুচিত হয়েছে।
Leave a reply