আল মাহফুজ
‘তার চেয়ে বরং আজন্ম যেমন
জ্বলছ ধিকিধিকি, একা, দিনরাত্রি
তেমনি করে জ্বলতে থাকো
জ্বলতে-জ্বলতে ক্ষয়ে যেতে থাকো
দিনরাত্রি জ্বলতে থাকো
মুখের কশ বেয়ে যতদিন রক্ত না গড়ায়।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় বলা হচ্ছে ‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’ সিনেমার কথা। বলা হচ্ছে জীবনের অন্যতম আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা। এই সিনেমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-উপাদান-অনুষঙ্গ পার্থিব পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠলেও ভাবগত দিক থেকে এটা ভিন্ন এক পরিপার্শ্বের সিনেমা। এ সিনেমা ভাবনার হরেক প্রকার গলি উন্মুক্ত করে। কখনও গানের মতো, কখনও কবিতার মতো জীবনবোধে দানা বাঁধে। মনে দাগ কেটে যায় প্রবলভাবে অথবা ঘোর লাগায়।
সিনেমার প্রধান চরিত্র ক্রিস ম্যাকেন্ডিলিস। ২৩ বছরের এই তরুণ ‘ক্যারিয়ার’ নামক উদ্ভট উদ্ভাবনকে পায়ে দলে বিচিত্র এক জগতের সন্ধানে নামে, যেখানকার অকৃত্রিমতা দুদণ্ড শান্তি দেবে তাকে। সম্পর্কের বন্ধন উপেক্ষা করে এক নিমিষেই সে পাড়ি দিতে চায় আলাস্কায়। নর্থ আমেরিকার ‘মহান ভূখণ্ড’ আলাস্কায়। পদে পদে জড়িয়ে যায় নানা রঙের মানুষের সাথে। কেউ কেউ তার মতোই যাযাবর, কেউ বা স্থানীয় বাসিন্দা। প্রায় সবার মনের গহীনে ম্যাভেরিকের ঠাঁই হয়। কিন্তু ক্রিস সেই আরামদায়ক অরণ্যে আশ্রয় নেয় না। তার অরণ্য যেন প্রকৃতির বুকে। তার শান্তিবাদী ফিলোসফির পথ অভিজ্ঞতা অর্জনে, বন্ধনে নয়।
ক্রিসের আছে দুঃসহ অতীত। সে সেই খাঁচা থেকে বের হতে চায়। সমাজের মুখস্ত সামাজিকতা থেকে ‘নিরন্তর’ মুক্তি চায়। তাই নিজের নাম রাখে ‘সুপারট্রাম্প’। নিসর্গের মাঝে ভবঘুরের মতো জীবন যাপনেই তার সমস্ত সার্থকতা। সে একাকী বাঁচতে চায়। তার কাউকে দরকার নেই, কোনো কিছুর দরকার নেই।
সিনেমাজুড়ে ঘটনার বিস্তারে শ্রুতিমধুর ও অর্থবহ কিছু গান বাজতে থাকে। আমাদের জীবনট্রেনেও কি এই সাইরেন বেজে চলে না, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে? অনবদ্য আবহ সংগীতের আয়োজনে ছিলেন এডি ভেডার। সেবছর গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
‘ক্রিস’রুপে অভিনয়ে ছিলেন এমিল হার্স। মানিয়ে গেছেন ক্যারেক্টারে, খারাপ করেননি। তবে আরেকটু ভালো করার সুযোগ ছিল তার। এছাড়া উইলিয়াম হান্ট, মার্সিয়া হার্ডেন পরিচিত মুখ। ‘ক্যামিও’ চরিত্রে সপ্রতিভ ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট।
‘ইনটু দ্য ওয়াইল্ড’-এর নির্মাতা শন পেন। হুম, বিখ্যাত অভিনেতা শন পেন। এটার পর আর মাত্র একটি সিনেমাই বানিয়েছেন তিনি। তবে ‘মাস্টারপিস’ ছবির নির্মাণ একটি হলেই যথেষ্ট। জন ক্রাকাউয়ের বই থেকে এডাপ্ট করে চিত্রনাট্য তৈরি করেন পেন। সিনেমার একেকটি সংলাপ যেন আদর করে বুক পকেট থেকে বের করা। শুনলে মায়াময় মনে হয়। যেমন মৃত্যুর সময়ে ত্রিশ কেজি ওজনের ক্রিস বইয়ের পাতার ফাঁকে লিখে যায় তার অন্তিম উপলব্ধি– ‘হ্যাপিনেস অনলি রিয়াল, হোয়েন শেয়ারড’। অর্থাৎ, ভাগাভাগি করলেই কেবল পরিপূর্ণ হয় সুখ।
ক্রিস ম্যাকেন্ডিলিস রক্ত মাংসে গড়া একজন মানুষ ছিলেন। সিনেমাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। একারণেই ক্রিসের অযাচিত মৃত্যু আমাদের বুকে পাহাড় ভাঙ্গে? একারণেই চড়ুইয়ের মতো টুপ করে উড়ে আসে অশ্রু? নাকি আমরা ক্রিসের মুক্তি দেখে আনন্দেই কেঁদে উঠি?
ক্রিসের মুক্তির দর্শন সম্ভবত সবার মাঝে বিদ্যমান। ব্যতিক্রম কেউ নিরেটভাবে তা প্রকাশ করতে পারে, কেউ করে হুল্লোড়ে। কারও মাঝে তা আজীবন ‘সুপ্ত’ই রয়ে যায়। নিজেও জানতে পারে না কখনও! সিনেমা শুরু হয় লর্ড বায়রনের একটি কবিতা দিয়ে। লেখাটি শেষ হয় তার উদ্ধৃতি টেনে—
‘দেয়ার ইজ আ প্লিজার ইন দ্য পাথলেস উডস
দেয়ার ইজ আ র্যাপচার অন দ্য লোনলি শোর
দেয়ার ইজ সোসাইটি হোয়্যার নান ইনট্রুডস
বাই দ্য ডিপ সি, অ্যান্ড মিউজিক ইন ইটস রোর
আই লাভ নট ম্যান দ্য লেস, বাট ন্যাচার মোর’
Leave a reply