মিশুক নজিব ⚫
একই বছরে দুইটি সংসদ নির্বাচন! এখন পর্যন্ত একবারই দেখেছে বাংলাদেশ। ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর সপ্তম সংসদ নির্বাচন হয় এর চারমাস পর, ১২ জুন। এরমধ্যে বছরের শুরুতে হওয়া নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি। আর পরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর ক্ষমতার স্বাদ পায় আওয়ামী লীগ।
৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচন:
বিরোধী দলগুলোর দাবি ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এই নির্বাচন দিতে হবে। তবে, ক্ষমতাসীন দল বিএনপি তাদের দাবি আমলে নেয়নি। ’৯৫ এর ২৪ নভেম্বর ভেঙে দেয়া হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ, আর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।
সেই ভোটে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ বিরোধী দল অংশ নেয়নি। বিএনপিসহ ৩টি দল ভোটে যায়। বিএনপি ২৭৮টি আসন পেয়ে একতরফা জয়লাভ করে। বাকি দুটি দলের মধ্যে ফ্রিডম পার্টি একটি আসন পায়। বাকি ১০ আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এছাড়া ১০টি আসনে ফলাফল অসমাপ্ত ছিল এবং একটি আসনের নির্বাচন আদালতের আদেশে স্থগিত করা হয়।
উল্লেখ্য যে, এই ভোটে ৪০টির বেশি আসনে ছিল না একাধিক প্রার্থী। আর সেসব আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল বিএনপির প্রার্থীরা।
একতরফা এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। ইসির হিসেবে ভোটপ্রদানের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ভোটের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় অন্তত ১০ জনের নিহত হবার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে।
‘ভোটারবিহীন’ এ নির্বাচন নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছে। এখনও আওয়ামী লীগ এ নির্বাচন নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করে। যদিও তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রধান যুক্তি ছিল, ভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন জোরদার করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এই আন্দোলনে যুক্ত হয় সরকারি কর্মচারীদের একাংশ। তাতে প্রশাসনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সেভাবে থাকেনি।
সংসদ নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় এবং সেদিন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। তীব্র আন্দোলনের মুখে ২১ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল উত্থাপন করা হয়। ২৬ মার্চ গভীর রাতে সেই বিল পাস হয়। আর ৩০ মার্চ ভেঙে দেয়া হয় এই সংসদ। মাত্র ১১ দিন টিকে ৬ষ্ঠ সংসদ। এখন পর্যন্ত এই সংসদের মেয়াদকালই সবচেয়ে কম।
সপ্তম সংসদ নির্বাচন:
পরিবর্তিত সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে ৩১ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস। তার নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই ভোট হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। প্রধান দু’দলের মধ্যে চলে জোরালো লড়াই।
ছিয়ান্নব্বইয়ের এ ভোটে অংশ নিয়েছিল মোট ৮১টি দল। প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৭৪। ভোটের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন পায়। অপরদিকে বিএনপি পায় ১১৬টি। সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় আসন থেকে মাত্র ৫টি কম পেয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
জাতীয় পার্টির সমর্থনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। আর বিরোধী দলের নেতা হন খালেদা জিয়া।
লাঙ্গলের প্রার্থীরা এই ভোটে ৩২টি আসনে জয় পেয়েছিল। আর জামায়াতে ইসলামী পায় ৩টি আসন। এছাড়া, জাসদ (রব) ও ইসলামী ঐক্যজোট একটি করে আসন পায়। মাত্র ১টি আসনে জয় পেয়েছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী।
এই নির্বাচনের প্রচারণায় ভুল-ত্রুটি ক্ষমা চেয়ে দেশ ও জাতিকে সেবা করার সুযোগ চান শেখ হাসিনা। দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিবেশী ভারতের সাথে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদন করা হবে। আর দেশটির সাথে ১৯৭২ সালে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তি নবায়ন করা হবে না।
ভোটের প্রস্তুতি ও প্রচারণা যখন চলছিল, দেশে তখন ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। তৎকালীন সেনাপ্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস। ২০ মে এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এই সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
পরে ঠিকঠাক মতো ভোট আয়োজিত হয়। তাতে ৭৩ শতাংশ ভোটগ্রহণের কথা জানায় ইসি। তবে সেই ভোটের ফলাফল মেনে নেয়নি বিএনপি। দলটি ১১১টি আসনে পুনঃনির্বাচন দাবি করে। যদিও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো জানায়, সপ্তম সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
১৯৯৬ সালের ১৪ জুলাই গঠিত এ সংসদ বহাল থাকে ১৩ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত। সিলেটের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
Leave a reply