মুখেই যত গর্জন ‘কিংস পার্টি’র, ভোটের লড়াইয়ে খরা বর্ষণ

|

বিরোধী দল হবে, এমন প্রত্যাশার কথা দুইটি দলই জানিয়েছিল। কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে খুঁজেই পাওয়া গেলো না তাদের। ভরাডুবি হয়েছে তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এর।

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, চব্বিশের ভোটে ১৩৫টি আসনে প্রার্থী ছিল তৃণমূল বিএনপির। আর বিএনএমের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৫৬টি আসনে। দুই দলের বেশিরভাগ প্রার্থীরই জামানাত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে।

এমনকি জামানাত হারানোর তালিকায় রয়েছেন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মবিন চৌধুরী। কেবল জামানত নয়, সিলেট-৬ (বিয়ানী বাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে ভোটের লড়াইয়ে দ্বিতীয়ও হতে পারেননি তিনি।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে ধরাশয়ী হয়েছেন শমসের মবিন চৌধুরী। নৌকা নিয়ে ৫০ হাজার ৯০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন নাহিদ। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারেননি সোনালী আঁশ মার্কার শমসের মবিন চৌধুরী।

আরও পড়ুন: ছাড়ের আসনেও তেমন সুবিধা করতে পারেনি জাতীয় পার্টি

এই আসনে ভোটের লড়াইয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কানাডা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সরওয়ার হোসেন। তিনি পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৬০৪ ভোট। আর সোনালী আঁশে ভোট পড়েছে ১০ হাজার ৯৩৬টি।

নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী, একটি নির্বাচনী এলাকায় যত ভোট পড়ে তার শতকরা সাড়ে ১২ শতাংশ কোনো প্রার্থী না পেলে প্রার্থিতার সঙ্গে জমা দেয়া জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়। সিলেট ৬-এ ভোট পড়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ৭০২টি। সে হিসেবে শমসের মবিন চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট সাড়ে ১২ শতাংশেরও কম।

জামানত হারানোর তালিকায় রয়েছেন দলটির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকারও। নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের ভোটযুদ্ধে তিনিও প্রথম, দ্বিতীয় স্থানে থাকতে পারেননি। নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে ১২৮ কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন ৩ হাজার ১৯০ ভোট। এই আসনে ভোট পড়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ৬২৪ ভোট। সে হিসেবে তৈমূরের ভাগ্যে জুটেছে মাত্র দেড় শতাংশ ভোট। এই আসনে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগের গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক) পেয়েছেন ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৩ ভোট।

তৃণমূল বিএনপির হেভিওয়েট নেতাদের যখন এই দশা, তখন তাদের কিছুটা সান্ত্বনা জোগাতে পারে বিএনএম। দলটিরও যে একই হাল।

বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ আবু জাফরের জামানতও বাজেয়াপ্ত হবে। ফরিদপুর-১ (বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা, মধুখালী) আসনে নির্বাচন করে ২২ হাজার ৪৬৫ ভোট পেয়েছেন তিনি। হারলেও দ্বিতীয় অবস্থানে নিজের নাম লেখাতে পারেনি শাহ আবু জাফর।

১ লাখ ২৩ হাজার ৩৩১ হাজার ভোট পেয়ে আসনটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফুর রহমান দোলন পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৯৮৯ ভোট।

তৃণমূল বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা শমসের মবিন ও তৈমূর আলম খন্দকারের মতো শাহ আবু জাফরও বিএনপির নেতা ছিলেন। নির্বাচনের আগে তিনি বিএনপি ছেড়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। পরে বিএনপি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। কিন্তু তিনজনেরই কপালেই একই ভাগ্য!

বিএনএমের মহাসচিব ড. মুহাম্মদ শাহ্‌জাহান ভোট করেছেন চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসন থেকে। তিনিও প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারেননি। হারাচ্ছেন জামানত।

আরও পড়ুন: শরিকদের দৌড় থামলো দুইয়ে, ইনু-মঞ্জু-বাদশার মুখ মলিন

এছাড়া, দলটির সাবেক আহ্বায়ক ড. আব্দুর রহমান বরগুনা-২ আসন ভোট করেও পরাজয়ের মুখ দেখেছেন। অন্যদিকে মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে ভোট করা তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদার মেয়ে ও দলটির নির্বাহী চেয়ারপারসন অন্তরা হুদাও সুখবর দিতে পারেননি।

যদিও ভোটের আগে থেকে দুই দলই হাঁকডাক দিচ্ছিল, বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে। বিশেষ করে তৈমূর আলম খন্দকার ও ড. মুহাম্মদ শাহ্‌জাহান এ নিয়ে প্রায়ই বক্তব্য দিয়েছেন। সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার আশ্বাসে তারা ভোটে এসেছে বলে জানান।

এছাড়া, বিএনএম মহাসচিব এ-ও জানায়, তারা যাচাইবাছাই করে শক্তিশালী প্রার্থী দেয়ায় তুলনামূলক কম আসনে প্রার্থী দেয়। না হয় আরও বেশি আসনে প্রার্থী দেয়ার সুযোগ ছিল তাদের। আর গত ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে তৃণমূল বিএনপির ৬০ প্রার্থী অভিযোগ করেন, শমসের-তৈমূর তাদের সঙ্গে বেঈমানি করেছে। তাদেরকে ভোটে নামিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।

এদিকে, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। দুইটি দলেই ভিড়ে বিএনপির কয়েকজন সাবেক নেতা। তার মধ্যে নিজেদের নামের মিল রেখে গঠন করা হয় তৃণমূল বিএনপি। অপরদিকে বিএনএমের প্রতীক নোঙ্গর নিয়ে আপত্তি তুলেছিল জাপা। কিন্তু তাদের সে আপত্তি টেকেনি। ভোটের আগে দলটি নিবন্ধন পাওয়ার পাশাপাশি প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ পায় নোঙ্গর। আর তৃণমূল বিএনপিও সব শঙ্কা কাটিয়ে নিবন্ধন পায়।

এই দুই দলের বাইরে ভোটের আগে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) নিয়েও কিছুটা আলোচনা ছিল। দলটি প্রতিষ্ঠা করেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর ভাতিজা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ। চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নির্বাচন করেন তিনি। তবে, নৌকার প্রার্থীর কাছে হেরেছেন বিএসপি চেয়ারম্যান। গত দুই নির্বাচনে আসনটি তার চাচার দখলে ছিল। ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে দু’বারই ভোট করে জয়ী হন নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। তবে এবার সমর্থন না পেয়ে ভোটে দাঁড়ালেও সরে দাড়ান শেষ মুহূর্তে। সমর্থন দেন নৌকাকে।

চব্বিশের ভোটে ৭৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএসপির প্রার্থীরা। তবে সবার ভাগ্য একই। জুটেছে পরাজয়।

দেশের রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’ টার্ম যেভাবে এলো:

‘এক-এগারো’র সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কিংস পার্টির ধারণা বাংলাদেশে মুখরোচক বিষয় হয়ে ওঠে। সে সময় জরুরি অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকলেও বিএনপির সাবেক নেতা ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি)। দলটি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৪৫ দিন আগে নিবন্ধন পায়।

একই বছরের ১৭ নভেম্বর নিবন্ধন পেয়েছিল মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। ওইসময় এ দুটি রাজনৈতিক দলকেই ‘কিংস পার্টি’ নামে অভিহিত করা হতো।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দুই রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে দেশে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সেই সঙ্গে ব্যর্থ কোরেশীর দল হারিয়ে গেছে রাজনীতি থেকে। আর কল্যাণ পার্টি এবারের ভোটের আগে ‘ডিগবাজি’ দেয়। নিজেদের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সরকারের অধীনে ভোটে অংশ নেয়।

কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম নিজের এলাকা ছেড়ে ভোট করেন কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন থেকে। এই আসনে নৌকার প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয় ঋণ খেলাপির দায়ে। পরে আওয়ামী লীগের সমর্থনে জয় পান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। যা সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো কোনো আসনে দলটির প্রার্থীর জয়।

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply