নিলয় দাশ চায়ের কাপের ছাই না হোক

|

আল মাহফুজ

বাংলাদেশে সংগীতের আরোহী যাত্রার ক্ষেত্রে অনেকের অবদান রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সুধীন দাশ। বলতেই হয়, বাংলা গানকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। আজীবন সঙ্গীতের সাধনা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকে নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন সুধীন দাশ। জাতীয় কবির মৃত্যুর পর মোট ২১ খণ্ডে নজরুলের গানের স্বরলিপি গ্রন্থ বের করে শুদ্ধ সংগীত সাধনায় অনন্য ভূমিকা রাখেন তিনি। লালনগীতির ক্ষেত্রেও সুধীন দাশের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তার ছেলের নাম নিলয় দাশ।

বাংলাদেশের কার্লোস সান্টানা

খুব কম মানুষজনই চিনে থাকবেন নিলয় দাশকে। অন্যান্য ব্যান্ড শিল্পীরা (আজম খান-আইউব বাচ্চু-জেমস) যেভাবে সাধারণ মানুষের মনের মণিকোঠায় পৌঁছে গেছেন, নিলয় দাসের হয়তো সেভাবে সবার হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার কোনো আরজ ছিল না। তবে গানের জগতের মানুষ ছাড়া নিলয় দাস সম্পর্কে ক’জন কথা বলেন? ক’জন সংগীতপ্রেমি তার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন? সংখ্যাটা বোধ করি খুব বেশি হবে না।

নিলয় দাশ একজন আপাদমস্তক সংগীতশিল্পী। বাংলাদেশের ব্যান্ড ইতিহাসের কিংবদন্তি গিটারিস্ট। তুখোড় গিটার বাজাতেন। গান গাইতেন। আজকাল মানুষের মধ্যে গিটার শেখার যে প্রবল আগ্রহ, তার অনেকটাই এসেছিল নিলয় দাশের হাত ধরে। তার কাছেই গিটারের হাতেখড়ি হয়েছিল ‘বেজবাবা’ সুমন, ওয়ারফেইজের কমল, বাপ্পা মজুমদার, পার্থ বড়ুয়াসহ অনেকের। নির্দ্বিধায় তাই বলা যায়– এখনকার প্রথম সারির ব্যান্ডের অনেক গিটারিস্টই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিলয় দাশের হাত ধরে উঠে এসেছেন।

আরেক গিটার আইকন আইয়ুব বাচ্চু বলতেন, নিলয় দাশ হলেন বাংলাদেশের কার্লোস সান্তানা। বিশ্বের সেরা ১০ গিটারিস্টের একজন কার্লোস সান্তানা। তার মতো করে নিলয়কেও ডাকা হতো ‘গিটারিস্ট তৈরির কারখানা’ হিসেবে। বাংলাদেশে প্রথম ইন্সুট্রুমেন্টাল কনসার্ট করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন এই গিটার মায়েস্ত্রো।

নিলয় দাশের প্রথম অ্যালবাম।

‘ট্রিলজি’ থেকে যখনই নিবিড় করে..

নিলয় দাসের ব্যান্ডের নাম ছিল ‘ট্রিলজি’। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ফুয়াদ নাসের বাবুর সুর ও সংগীত আয়োজনে নিলয়ের একক অ্যালবাম ‘কত যে খুঁজেছি তোমায়’। আশিকুজ্জামান টুলুর সংগীত পরিচালনায় ১৯৯২ সালে বের হয় দ্বিতীয় একক ‘বিবাগী রাত’। একক অ্যালবামে কম কাজ করলেও প্রচুর মিক্সড অ্যালবামে কাজ করেছেন নিলয় দাশ।

খুব বেছে বেছে গান করতেন নিলয়। যারা তাকে ভালোবাসেন, তাদের প্লেলিস্ট হরহামেশা ঘুরতে থাকে– ‘কত যে খুঁজেছি তোমায়’, ‘এ শহর ডুবে যায়’, ‘বৃষ্টির কান্না দেখে’, ‘লাশকাটা ঘরে’, ‘অবহেলা’সহ অসংখ্য গানে। যেসব গানের লিরিক-সুর, নিলয় দাসের গিটারওয়ার্ক শ্রোতার বুকে এমনভাবে বিদ্ধ হয় যে, বেদনার রেশ বিরাজ করে বিরান কালে। স্বরাজ চলে নিলয় দাসের বিমূর্ত বাদন।

‘যখনই নিবিড় করে’ তার সবচেয়ে বিখ্যাত গান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এই প্রজন্মের অনেকেই এটাকে চেনে এলিটা করিমের গান বলে (‘বন্য’ অ্যালবামে এলিটা কাভার করেছিল গানটি)। নিলয় দাশের প্রিয় বন্ধু ছিলেন আরেক কিংবদন্তি হ্যাপি আখান্দ। প্রয়াত সখাকে নিয়ে গেয়েছিলেন– হ্যাপি.. তোকে মনে পড়লেই.. একটা গিটার তোলে ঝঙ্কার.. পিয়ানোটা বেজে ওঠে.. তোর সেই নিপুণ হাতে.. ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ মনে পড়ে যায় মাঝরাতে..। এই গানের লিরিক লিখেছিলেন আসিফ ইকবাল। স্মৃতিমেদুর লিরিকে বেদনাবিধুর গায়কী! তোলপাড় তোলে অনুরণনে। ‘সচেতন বিস্মরণ’ মনে পড়ে। ভোলা যায় না হ্যাপিকে। নিলয়কেও।

গিটার হাতে নিলয়।

অভিমানী, হারিয়ে গেছে কোথায়?

বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক প্রথমবারের মতো ব্লুজ, নিও ক্লাসিক্যাল, কান্ট্রি, ফ্ল্যামেঙ্কো, জ্যাজসহ আরও অনেক পাশ্চাত্য সঙ্গীতের শাখার সঙ্গে পরিচিত হয় নিলয় দাশের সুবাদে। কোনটা রক-হার্ড রক, কোনটা জ্যাজ কিংবা ব্লুজ, শিষ্যদের হাতে ধরে শেখাতেন সেসব। বিশ্বসংগীতের সকল জানালা খুলে রাখতেন। আরেক গিটার মায়েস্ত্রো নয়ন মুন্সীকে দেখে গিটার হাতে তুলে নেয়া নিলয়ের সংগীত সুধা পানে ছিল অবিশ্বাস্য ঝোঁক।

মিউজিক অন্তঃপ্রাণ এই গিটার বাদক অভিমানীও ছিলেন। অভিমানের চাদর গায়ে জড়াতেন একটু বেশিই। ২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি পৃথিবীর মায়া ছাড়েন সন্তর্পণে। ‘একুশ গ্রাম’ ভর হারায় গিটার মাইলস্টোনের দেহ। স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিককে যে উচ্চতায় তুলে দিয়েছেন নিলয়, তার আধেক ঋণও কি শোধ করা যায়? সম্ভব কোনোকালে?

আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, নিলয় দাশের মতো করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আর কেউ গিটার বাজাতে পারে না। হি ইজ দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি নিউ ক্ল্যাসিক্যাল গিটারিস্ট, গিটার প্লেয়ার। আনফরচুনেটলি বাংলাদেশ ওকে হারিয়েছে। ওর অভিমান থেকে ও চলে গেছে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গিটারিস্টের আজ প্রয়াণ দিন। লেখাটারও ইতি টানা যাক তার গাওয়া একটি গানের বাণী দিয়ে–

‘সাগর ডেকে বলে তার বুকের নোনা জলে
কত নদীর কত স্মৃতি সে আছে ধরে
নদীরা সাগরকে আজও মনে করে, এইতো অনেক
পৃথিবীতে কেবা কাকে মনে রাখে স্মৃতিতে আধেক?’

পুনশ্চ: অনেক বছর পর ‘এই গানটা’ নামে একটি লিরিক লিখেছিলেন গীতিকবি শেখ রানা। সেই লিরিক বাপ্পা মজুমদারেরর কণ্ঠে হয়ে ওঠে গান। সেই গানে বাংলা গানের তিন মায়েস্ত্রোর কথা উঠে আসে। উঠে আসে সঞ্জীব চৌধুরী, হ্যাপি আখান্দের কথা। নিলয় দাসের কথাও উঠে আসে। নিলয় দাস জাতিস্মর হোক, চায়ের কাপের ছাই না হোক।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply